রায়হান আহমেদ তপাদার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন, পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে এবং কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে বিদেশিদের তৎপরতা আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এমন বেশির ভাগ দেশেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত হতে পারেনি বলেই বিদেশি শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। আবার এসব দেশের তুলনামূলক দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থাও একটা বড় কারণ যার সুযোগ প্রভাবশালী দেশ বা গোষ্ঠীগুলো নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র না থাকা আর দেশটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিদেশিদের প্রভাব এড়ানো যায় না। সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করে আসছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একটু একটু ভালো হচ্ছিলো তখন অনেক সময় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে শক্ত কথাও বলতে দেখা গেছে মাঝেমধ্যে। আসলে অর্থনীতি ভালো হলে তখন আর কারও দ্বারস্থ হওয়ার দরকার হয় না। সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালী দেশগুলো সবসময় সক্রিয় থাকে। তারা চায় অন্য দেশের সরকারগুলো তাদের ঘনিষ্ঠ হোক। আবার দেশের অভ্যন্তরে যারা রাজনীতি করে তারা চিন্তা করে বড় নেতাদের কাছে না গেলে আমার কোনো পরিণতি হয় কে জানে। এসব কারণেই দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাব বাড়তে থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কি বাংলাদেশকে চীন ও রাশিয়ামুখী করছে? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে চীনের সমর্থন এবং বাংলাদেশের ব্রিকস-এ যোগদানের ঘোষণার পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশ কোনো একটি দিকে না ঝুঁকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনের যে লড়াই চলছে তাতে কোনো দিকে এককভাবে অবস্থান নিতে চাইছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি চলছে। আর বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নীতি নিয়ে যে কাজ করছে তারই অংশ হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন ‘চাপের’ মুখে আছে বাংলাদেশ। চীন এর বিপরীতে যে কথা বলছে, তা আসলে দুই দেশের অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে বলছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি এবং তার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে এরই মধ্যে অনেক লেখালেখি হয়েছে। মুখে যে যা-ই বলুক, সব পক্ষই যে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ভিসা নীতি কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ক্ষমতার বলয়ের অন্তর্গত বিভিন্ন পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের পাচার করা অর্থসম্পদ, বাড়িঘর এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়া তাদের জন্য দুরূহ। মার্কিন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি চাপ সৃষ্টির প্রয়াস। এর আগে গণতন্ত্র সম্মেলনে নিমন্ত্রণ না করা এবং র?্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, আর এরপর দুই দফায় ১২ জন কংগ্রেসম্যানের চিঠি-সবই একই প্রক্রিয়ার অংশ।
আপাতদৃষ্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভুত এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে বলেই প্রতিভাত হয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অঙ্গীকারের সঙ্গেও তা সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ঘিরে যে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে, তাতে জড়িত তিনটি বৃহৎ শক্তি-যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত।
এই তিন রাষ্ট্রের কার কী চাওয়া, সেদিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ নানা কারণে গত বছরগুলোয় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই চায় যে বাংলাদেশ চীনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসুক। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক রণকৌশল এবং কোয়াড সংগঠন চীনের প্রভাবকে সীমিত করার লক্ষ্যেই সৃষ্ট। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শেষ সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশ এই রণকৌশলে যুক্ত হোক। বাইডেন আমলেও এই প্রয়াস অব্যাহত। সংগত কারণেই বাংলাদেশ চীনবিরোধী একটি জোটে শরিক হতে আগ্রহী হয়নি। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের অযৌক্তিক দাবির বিষয়েও বাংলাদেশ বরাবর নীরব থেকেছে।
অন্যদিকে গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ যে ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা করেছে, তার সঙ্গে মার্কিন রণকৌশল সাংঘর্ষিক নয়। প্রধানমন্ত্রীর সামপ্রতিক জাপান সফর শেষে ২৬ এপ্রিল ঘোষিত যৌথ ইশতেহারেও তার প্রতিফলন আছে। এতে সমুদ্রসীমার বিষয়ে বাংলাদেশ আনক্লসের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে, যা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবির বিরুদ্ধে যায়। উভয় পক্ষের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার যে প্রয়াস বাংলাদেশ করে আসছে, এতে তাই প্রতিফলিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশে একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে-এমন প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভবত রয়েছে। ভিসানীতি থেকে শুরু করে কংগ্রেস সদস্যদের চিঠির মধ্যমে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশল সে কারণেই নিয়ে থাকতে পারে।
এ প্রসঙ্গে চীনের অবস্থান সে তুলনায় অনেক সরল। বাংলাদেশের নির্বাচন দিনে হলো না রাতে, চীনের তাতে কিছু যায় আসে না। গত ১৫ বছরে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা জেঁকে বসতে সক্ষম হয়েছে। চীন বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস।
বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাণিজ্যিক সুদে প্রচুর লগ্নি করেছে চীন। আবার অতিমূল্যায়িত অধিকাংশ মেগা প্রকল্পে ঠিকাদারি করে চীনা কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। অন্যদিকে সীমান্ত এবং ভারত মহাসাগরে আধিপত্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। বাস্তববাদী চীন অবশ্যই প্রত্যাশা করে না যে ভূগোলকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ কোনো সংঘাতে ভারতকে বাদ দিয়ে তার পক্ষ নেবে। চীনের প্রত্যাশা এই তিন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা। বর্তমান সরকার এ প্রত্যাশা পূরণ করছে এবং তাদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়া চীনের স্বার্থের অনুকূল। নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতিসহ যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ অনমনীয় অবস্থান নিয়েছেন। ১৪ জুন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শেখ হাসিনার অবস্থানকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন এবং মার্কিন আধিপত্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। চীনের তুলনায় ভারতের সমীকরণ অনেক বেশি জটিল। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের পশ্চাদযাত্রায়’ বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার ভারতের ভূমিকায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। সেটাকে বাদ দিলেও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র চলমান দ্বৈরথে ভারতের অভিন্ন স্বার্থ আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে চাওয়া (মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন), তার সঙ্গে সুর মেলাতে পারছে না ভারত।
স্পষ্টতই ভারত চাইছে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকুক। দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার মতোই, নির্বাচন নিয়েও চিরশত্রু ভারত ও চীনের স্বার্থ অনেকটাই এক হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অবিরাম বলে যাচ্ছেন যে বর্তমান সরকারের অধীন আগামী নির্বাচন হবে অবাধ ও স্বচ্ছ এবং জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, অন্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই হবে। কিন্তু সমস্যা হলো— সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃতবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই আশ্বস্ত হতে পারছে না যে আগামী নির্বাচনটি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না।
আলোচনা বা আইন পরিবর্তন যেভাবেই হোক এ বিশ্বাসটুকু ফিরিয়ে আনতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। নির্বাচনের এখনো মাস চারেক বাকি। আঞ্চলিক ভূরাজনীতির তিন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের হাতে আর কী কী তাস আছে, কী কী পদক্ষেপ তারা নিতে পারে বা নেয়, তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করবে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ। এ অনিশ্চয়তার চট করে অবসান হবে, এমন সম্ভাবনা কম। এখন শুধু পর্যবেক্ষণ আর অপেক্ষার পালা। আমাদের মনে রাখতে হবে, আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। এটা মাথায় রেখে আমাদের দেশে ধর্মীয় বা অন্য কোনো ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা থেকে দূরে থাকা উচিত। আমরা চাই না, আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হোক। এটি যে আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার বিরোধিতা করে এবং এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ তার বেশির ভাগ পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠায় বেশির ভাগ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে, যারা রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্র।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। এ কারণে সারা বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির সময় বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শুরু করেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কুৎসিত দিক আর নিষ্ঠুরতা দেখেছি, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা সমপ্রীতির সাথে বাঁচতে চাই, দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনতে চাই, তাদের আশা ও সমৃদ্ধি দিতে চাই। আমরা সবার কাছ থেকে চাইব আপনারাও বাঁচুন আর আমাদেরও মর্যাদার সাথে বাঁচতে দিন।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক