নিজস্ব প্রতিবেদক
মশা বাগে আনতে গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ, ড্রোন নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মাঠে নামলেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মশা। মশা ঠেকাতে বিটিআই এনে সে নিয়েও এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। মশার কামড়ে এ বছর ৭৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশা মারার সব পদ্ধতিকে ব্যর্থ করে দেড় লাখ লোককে আক্রান্ত করেছে এডিস মশা। মশক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা দরকার তার কোনোটাই মানে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তাদের শুধু ফগিংয়ে আগ্রহ। কারণ এখানে অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হয়। আমরা বারবার বললেও তারা শোনে না। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না। ডেঙ্গু জ্বরে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। এ মৃত্যুর দায় সিটি করপোরেশনের মেয়ররা এড়াতে পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিটিআই নিয়ে যা করা হয়েছে সেটা ভুল নয়, ক্রাইম। নিবন্ধিত কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি হলে বিটিআইর ওই প্যাকেটে কী আছে, তা জানা যেত। কিন্তু সিটি করপোরেশন এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করে, যাতে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান বিটিআই সরবরাহের কাজটি পায়।’ তিনি বলেন, ‘অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে বিটিআই আমদানি করে। তবে তারা যাতে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে আমদানির শর্ত দেওয়া হয়েছিল টেন্ডারে। সিটি করপোরেশনের লোক জড়িত না থাকলে ঠিকাদার এমন জালিয়াতি করতে পারেন না। পুরো ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।’
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশা মারার উদ্যোগ ডুবিয়ে দিয়ে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু ইতিহাস গড়েছে। এ বছর দেড় লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ হাজার ২৬ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৪১ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে মারা গেছেন ৫২৮ জন। গত বছর ২৮১ জনের মৃত্যু ছিল সর্বোচ্চ। এ বছর তার দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে মশার কামড়ে। মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করতে ২০২১ সালে ড্রোন ব্যবহার শুরু করে ডিএনসিসি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চালু করে ‘ব্যাঙ থেরাপি’ অর্থাৎ ব্যাঙ দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম। এ ছাড়া মশা নিধনে জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট, গাপ্পি মাছ ও হাঁস ছাড়ার ঘটনাও দেখেছে নগরবাসী। অভিযোগ আছে, গাপ্পি মাছের নামে ড্রেনে ছাড়া হয়েছিল ক্ষতিকর সাকার মাছ। ড্রেন থেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে মিশেছে নিষিদ্ধ এ সাকার মাছ। এখন নদীতে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে সাকার।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ দরকার কোনোটাই মানে না সিটি করপোরেশন। তাদের আগ্রহ ফগিংয়ে। কারণ এখানে অনেক টাকার ওষুধ লাগে। মৃত্যুর দায় মেয়ররা এড়াতে পারেন না।
ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী
গত জানুয়ারিতে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণে ফ্লোরিডার মায়ামিতে যায় তারা। সেখানে অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর গত ২০ জানুয়ারি মায়ামি থেকে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে। সে কারণে মশার লার্ভা ধ্বংস হয়নি বরং বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। মায়ামির ল্যাবরেটরিতে মশার প্রজাতি নির্ণয় করে বাসিলাস টুরিংজেনেসিস ইসরাইলেনসিস (বিটিআই) দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মায়ামির সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়ার মিল রয়েছে। তাই বিটিআই দিয়ে ঢাকায় মশা নিধন করা হবে।’ এরপর শুরু হয় বিটিআই আমদানি কার্যক্রম। গত জুলাইয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানির ঘোষণা দেয় ডিএনসিসি। দ্রুতই ৫ টন বিটিআই আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মার্শাল অ্যাগ্রোভেট লিমিটেড’। যদিও ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অপরাধে এক সময় প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল ডিএনসিসি। বিটিআই ব্যবহার শুরুর দিন লি ঝিয়াং নামে এক ব্যক্তিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বিটিআই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘বেস্ট কেমিক্যালস’-এর প্রতিনিধি হিসেবে। ওষুধ প্রয়োগের কলাকৌশল শেখাতে উপস্থিত হন তিনি। ঠিক যখন মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ শুরুর কথা, তখনই ধরা পড়ে সিঙ্গাপুর থেকে নয়, ওই বিটিআই এসেছে চীন থেকে। মার্শাল অ্যাগ্রো জালিয়াতি করে ডিএনসিসির কাছে গছিয়েছে পণ্যটি। আর লি ঝিয়াং সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানির কেউ নন, তার নাম জনি লি। ‘বেস্ট কেমিক্যালস’ তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, মার্শাল অ্যাগ্রোভেট বা ডিএনসিসিকে তারা বিটিআই সরবরাহ করেনি। তাছাড়া, বিটিআই সরবরাহ করার জন্য কীটনাশক আমদানিতে তিন বছরের অভিজ্ঞতা, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের নিবন্ধন বা বিশেষ অনুমতি সনদ, আইইডিসিআরের বায়ো-এফিশিয়েন্সি রিপোর্ট এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিলের যে শর্ত আছে তার কিছুই নেই মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের। ডিএনসিসি তখন বলে, ‘ওষুধ ভেজাল হলে সরবরাহকারীকে বিল দেওয়া হবে না।’ ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের কমিটি। ওই কমিটির রিপোর্ট এখনো জমা হয়নি। এ ঘটনায় চীনের ওই নাগরিকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এখন এ বিটিআই চীন থেকে আমদানি হলেও সমস্যা নেই, মান ভালো থাকলে সেগুলো প্রয়োগ করা হবে। খামারবাড়ির প্লান্ট প্রোটেকশন উইংয়ে (পিপিডব্লিউ) পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়। তারা জানায়, ‘এ কীটনাশকে উদ্ভিদের ক্ষতি হয় না। তবে আরও দুটি পরীক্ষা বাকি।’ মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা-ব্যর্থতা বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। গত শনিবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজে আলোচনা সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসি সফল নাকি ব্যর্থ, সে বিচার জনগণ করুক। সিটি করপোরেশন যে সক্রিয় রয়েছে, জনগণ তা দেখছে। আমরা বসে নেই, মশক নিধনে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছি। জনগণকে সম্পৃক্ত করছি, সচেতনতা বাড়াচ্ছি। মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। শিশুদের সচেতনতামূলক কার্টুন বই দিচ্ছি। ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে সবার ঢাকা অ্যাপস ও ফেসবুক পেজে এলাকাভিত্তিক মশক কর্মীর তালিকা দেওয়া আছে। সবাই সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।’