ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে জাতিসংঘে জড়ো হচ্ছেন বিশ্বনেতারা

ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে জাতিসংঘে জড়ো হচ্ছেন বিশ্বনেতারা

বিশ্বজুড়ে চলছে ভূরাজনৈতিক ছায়া উত্তেজনা। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের প্রতিযোগিতা এই উত্তেজনাকে উসকে দিয়েছে বহুগুণ। যার জের দেখা যাচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার থেকে শুরু করে জ্বালানি, স্বাস্থ্য ব্যয়সহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। কোনো কোনো দেশ এই প্রতিযোগিতার মাশুল দিচ্ছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কবলে পিষ্ট হয়ে।

এমনই এক অবস্থার মধ্যে আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘে মিলিত হচ্ছেন বিশ্বনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সংস্থার সদর দপ্তরে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। স্বভাবতই সবার নজরে থাকছে জাতিসংঘের এ আয়োজন। বিশ্বনেতাদের এ সম্মিলন কি বিশ্ববাসীর জন্য কোনো স্বস্তির খবর আনবে?

বিশ্বনেতাদের এই বাৎসরিক মিলনমেলা ও তার সম্ভাব্য আলোচ্যসূচি এবং জনসাধারণের প্রত্যাশা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো নানা খবর প্রচার ও প্রকাশ করছে। রয়টার্সের এমনই এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে আলোচনার অন্যতম মূল বিষয় হবে এই যুদ্ধ। অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও। সংঘাত শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথম সশরীরে জাতিসংঘ অধিবেশনে থাকছেন ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট।

অধিবেশনের মূল বিষয়ের মধ্যে থাকবে ‘গ্লোবাল সাউথ’ও। ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলতে জাতিসংঘের অন্তর্গত উন্নয়নশীল দেশগুলো। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন এবং বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় ধনী দেশ। রাশিয়াকে ‘এক ঘরে’ করতে এই ‘গ্লোবাল সাউথ’ ধারণা নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।

অধিবেশনে কিছু উচ্চপর্যায়ের সভা হবে, যেখানে প্রাধান্য পাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু, স্বাস্থ্য, উন্নয়নে অর্থায়নের বিষয়াদি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০১৫ সালে প্রণীত বৈশ্বিক ‘করণীয় তালিকা’র অগ্রগতিরও পর্যালোচনা হবে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর জাতিসংঘ পরিচালক রিচার্ড গওন বলেন, ‘এ বছরই গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো তাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এক্ষেত্রে অ-পশ্চিমা দেশগুলো কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। আমি মনে করি, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র অন্যদিকে রাশিয়া তাদের সমর্থন চায়, এটা বুঝেই এ মুহূর্তে সুযোগটি নিয়েছে গ্লোবাল সাউথ।’

গত দশকে চীন তাদের বহুল আলোচিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নে অপরিহার্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কোটি কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। যে কারণে অনেক দেশ ঋণের ফাঁদে খাবি খাচ্ছে। যার ফলে বেইজিংকেও পড়তে হয়েছে সমালোচনার সাগরে।

চীনের এই ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্ররাও প্রতিশ্রুত উন্নয়ন ও জলবায়ু সহায়তা দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে।

জাতিসংঘ অধিবেশন ‍শুরুর প্রাক্কালে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বলছেন, তাদের মূল আলোচনায় থাকবে উন্নয়নশীল দেশের বিষয়গুলো। অধিবেশনে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইও জিইয়ে থাকবে বলে যে আলাপ চলছে, সেটা নাকচ করে দিচ্ছেন তারা।

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড এ বিষয়ে বলেন, ‘জাতিসংঘের এই সমাগম আমাদের কাছে ছোট বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাধান্যে থাকা বিষয়গুলো উপস্থাপনের সুযোগ। এটাকে আমি পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বলে দেখি না।’

এ বিষয়ে জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত জ্যাং জুন বলেন, ‘কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার ইচ্ছা বেইজিংয়ের নেই। চীনের অবস্থার উন্নতির ফলে এ দেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর জন্য আরও কিছু করতে চায়। কিন্তু আমরা প্রতিযোগিতা করছি না।’

একইভাবে জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেভেনজিয়া বলেন, ‘মস্কো কাউকে বাগে বা বশে আনতে চায় না। আমরা যা তা-ই আছি। নিজেরা যা করতে চাই সেটার পক্ষে আনতে আমরা কখনোই আমাদের বন্ধুত্বকে শর্ত বানাব না, যেটা আমাদের অন্য সহকর্মীরা করছেন।’

এবারের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনই অধিবেশনে অংশ নেবেন।

অধিবেশন উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এটা বছরের অন্যতম একটি কল্যাণকর মুহূর্ত, যখন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের নেতা এখানে জড়ো হন। তারা কেবল বিশ্ব পরিস্থিতির পর্যালোচনাই করেন না, এখানে সবার অভিন্ন মঙ্গলের জন্য কাজ করারও সুযোগ মেলে।’

জলবায়ু সংকট, ছড়াতে থাকা সংঘাত, বৈশ্বিক জীবনযাপনে ব্যয়ের সংকট, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, আকস্মিক প্রাযুক্তিক বিপর্যয়সহ বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান অস্থিরতা তুলে ধরে মহাসচিব বলেন, ‘এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জনগণ তাদের নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’

দ্য ‘বিগ শো’

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরবর্তীকালে বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সেই চেষ্টাকে থমকে দিয়েছে বলা যায়। বিশ্বজুড়ে সরবরাহ লাইনে বিঘ্ন, গ্যাসসহ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং খাদ্যসহ পণ্যের বাজারের ঊর্ধ্বমুখিতার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকেই দোষারোপ করে আসছেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতারা। এজন্য বারবার যুদ্ধ থামানোয় জোর দেওয়া হচ্ছে বৈশ্বিক সভা-সমাগমগুলোতে।

সেই ধারাবাহিকতায় এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনেও ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর আহ্বান বেশি উচ্চারিত হবে বলা যায়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের সংকটে খাদে না ফেলতে এই যুদ্ধের অবসানেরই ডাক দেবে বলে কূটনীতিকরা আভাস দিচ্ছেন।

যদিও যুদ্ধের মূল ভূমিকায় থাকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না। তবে তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিনিধি থাকছেন বিশ্বনেতাদের এই সমাগমে।

অধিবেশন চলাকালে বিশ্বনেতাদের পাশাপাশি গণমাধ্যমের ক্যামেরার ফোকাসে থাকছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি আগামী মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দেবেন। পরদিন বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভায়ও কথা বলবেন তিনি। ওই সভায় একই টেবিলে দেখা যেতে পারে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে।

জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নেভেনজিয়া মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদের নির্ধারিত এ সভাই হবে জাতিসংঘের এবারের আয়োজনের ‘বিগ শো’।

পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলছেন, তারা এ বছর ইউক্রেন ইস্যুতে কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে ‘টার্গেট’ করার প্রচেষ্টা চালাবেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বাদবাকি বিশ্বের সংকট ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো তাৎপর্য হারাবে।

এ বিষয়ে জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেন, “এটা ‘হয়তো/অথবা’ এমন কোনো বিষয় নয়। আমাদের দুটোই করতে হবে।”

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ