রাজশাহীর চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে গতকাল রবিবার। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন।’
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এই সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে—গত ১১ সেপ্টেম্বর এমন বক্তব্য দেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইমরান আহমেদ। গত ১৫ আগস্ট কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ওসি মো. ফারুক হোসেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে আবারও নির্বাচনে জয়ী করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি ‘মিনতি’ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
একই দিনে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর আওয়ামী লীগকে নিজের দল উল্লেখ করে আগামী নির্বাচনে দলকে জেতানোর আহ্বান জানান। তাঁদের তিনজনকেই পরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
এসব কর্মকর্তার আচরণ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার গুরুতর লঙ্ঘন। এই বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা তার অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না।
তাঁরা দেশে-বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো ধরনের সহায়তা করতে পারবেন না, করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
তার পরও কেন সরকারি কর্মকর্তারা নানা রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর কারণ যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। গুরুতর এসব অভিযোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
৯ বছরেও আচরণবিধির খসড়া চূড়ান্ত হয়নি
দীর্ঘ ৯ বছরেও সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। এর আগে ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়। এর পরও কিছু বিষয় অস্পষ্ট থাকায় ২০১৪ সালে আবার বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। এই বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা আছে। কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেফাঁস বক্তব্যের বিষয়ে কিছু বলা নেই।
বিধিমালা সংশোধনের কাজ এখন কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিধি অনুবিভাগের কর্মকর্তারা তা বলতে পারেননি; যদিও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অসদাচরণ, অনিয়মসহ নানা অপরাধের শাস্তি হওয়ার কথা এই বিধিমালায়।
আর শাস্তির ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা বাতিল করে ২০১৮ সালে নতুন বিধিমালা করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি অনুবিভাগ) মহিদুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আচরণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ কোন অবস্থায় আছে বলতে পারছি না।’ তিনি বিধি-১ অধিশাখায় খোঁজ নিতে বলেন। বিধি-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো কাজ করছি না। আমার কাছে কোনো তথ্যও নেই।’
কোনো রাজনৈতিক দল দাওয়াত করলেও যেতে পারবেন না সরকারি কর্মকর্তারা
গত ১ জুলাই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপমা ফারিসা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সমালোচনার শিকার হন। ১৯৬৩ সালের সরকারি কর্মচারি সংক্রান্ত এক আদেশে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল দাওয়াত করলেও সরকারি কর্মচারীরা তাতে অংশ নিতে পারবেন না।
জানতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানের মঞ্চেও উঠতে পারবেন না। স্থানীয় পর্যায়ে শুধু মন্ত্রী-এমপিদের প্রটোকলের ব্যবস্থা করবেন তাঁরা। কিন্তু সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার অপূর্ণতার কারণে কর্মকর্তাদের অসদাচরণের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়েছে।
ফিরোজ মিয়া জানান, এ বিষয়ে পাকিস্তান আমলের কয়েকটি প্রজ্ঞাপন আছে। ওই প্রজ্ঞাপনগুলো বাতিল করে নতুন বিধিমালায় যুক্ত করা হয়নি। ফলে বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায় অস্পষ্ট ও দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। এ জন্য পুরনো আদেশগুলো বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায় যুক্ত করে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা করা উচিত।
শাস্তি শুধু প্রত্যাহার
এই সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে—এমন বক্তব্য দেওয়ার পর জামালপুরের ডিসি ইমরান আহমেদকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করে নির্বাচন কমিশন। ঘটনার তিন দিন পর তাঁকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
একইভাবে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার ওসি মো. ফারুক হোসেন, জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধরকে তাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, গণকর্মচারীদের এভাবে একটি দলের জন্য ভোট চাওয়া গুরুতর অপরাধ এবং এর বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেই এই প্রবণতা বাড়ছে।
চলতি বছরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়া নড়াইলে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। সমালোচনার মুখে সরকার তাঁকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা রাজনীতি করতে পারেন না। অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।