পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে আলুর বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। গত চারদিনে হিমাগার থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে আলুর বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর হয়নি। রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৪৫-৫০ টাকায়। দেশের প্রায় ৩৮০ হিমাগার থেকে আলু বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সরবরাহ সংকটে খুচরা বাজারে ফের আলুর দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রবিবার থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৬-২৭ টাকা কেজি দরে হিমাগার থেকে আলু বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু কোনো হিমাগার থেকে এই দামে আলু বিক্রি করা হয়নি। এককালের কাগুজে শেয়ারের মতো আলুর বাজারেও চলছে ‘স্লিপ বাণিজ্য’। ব্যবসার ধরন অনেকটা ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারের ‘এসও ও ডিও’ ব্যবসার মতোই। সংরক্ষণ করা আলু হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা স্লিপ বাণিজ্যের মাধ্যমে বহুজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তুলে নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। আলুর বাজার জিম্মি হয়ে পড়ছে স্লিপধারী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হিমাগারগুলোতে বেঁধে দেওয়া ২৬-২৭ টাকা দামে আলু বিক্রি হলে সব খরচ বাদ দেওয়ার পর প্রতিকেজিতে মজুতদার ব্যবসায়ীদের মুনাফা হবে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকায় আলু বিক্রি হলে পাইকারি পর্যায়ে ৬-৭ টাকা মুনাফা হবে। আর খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজিতে ৩-৪ টাকা মুনাফা করবেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যে প্রতিকেজি আলু বিক্রিতে হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা মুনাফা করছেন ১৮-২০ টাকার মতো। দুই-একটি হিমাগারে যেগুলো চালু আছে সেখানে এখনো প্রতিকেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করলে সবার মুনাফা থাকবে। বিশেষ করে হিমাগারে মজুতদারদের প্রতিকেজিতে ৭-৮ টাকা মুনাফা হবে। এরপরও তারা হিমাগার থেকে আলু ছাড়ছে না। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযানে আরও বেঁকে বসেছে হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা। আলুর বাজারের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে পারবে না বলে মনে করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকে আলু বিক্রি প্রায় বন্ধ মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে। একই অবস্থা বিরাজ করছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর হিমাগারগুলোতে। সেখানেও আলু বিক্রি বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হলেও সবাই মুনাফা করবেন কিন্তু সেই ক্ষেত্রে মুনাফা কিছুটা কম হবে হয়তো। এটাও অনেক ব্যবসায়ী মানতে পারছে না।
এ কারণে আলু বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, হিমাগারের বেশিরভাগ আলুর মালিক এখন স্লিপধারী মজুতকারীরা। হিমাগার মালিকদের এখন আর বেশি আলু নেই। অনেক পেশাজীবী ও চাকরিজীবী হিমাগার থেকে আলু কিনে স্লিপ নিয়ে গেছেন। এটাই ব্যবসা। এখন তারা যদি আলু বিক্রি না করেন সেক্ষেত্রে হিমাগার মালিকরা কি করতে পারেন! তিনি অভিযোগ করে বলেন, আলু ব্যবসায় অনেক পেশাজীবী ও টাকার মালিকরা এসেছেন। শুধু স্লিপ কিনে আলু মজুত করছেন। স্লিপ বাণিজ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে। এসব ব্যবসায়ীর দিকে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কঠোর মনিটরিং করতে হবে।
আলু ব্যবসায় স্লিপ বাণিজ্য ॥ ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারে যেমন কাগুজে শেয়ারের মতো স্লিপ বাণিজ্য বিশেষ করে সাপ্লাই অর্ডার (এসও) কিংবা ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ঠিক একইভাবে আলুর বাজারে এখন স্লিপ বাণিজ্য রমরমা হয়ে উঠছে। শুধু স্লিপ কিনেই হিমাগারে সংরক্ষণ করা আলুর মালিক যে কেউ হতে পারছেন। এতে করে হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর মালিক এখন বহুজন। স্লিপ কিনে যারা আলু কিনে বিক্রি করছেন তারা এখন বিরাট শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। দেশের প্রতিটি হিমাগারে এখন স্লিপ বাণিজ্য হচ্ছে। সূত্র জানায়, নগদ অর্থের প্রয়োজনে বাজারে স্লিপ বাণিজ্যের নামে ডিও এবং এসও ছেড়ে অর্থ তুলে নিয়েছে হিমাগার মালিক ও মজুতদারী ব্যবসায়ীরা। এখন স্লিপধারীরা আলুর দাম বাড়াচ্ছেন ইচ্ছেমতো।
কঠোর অবস্থানে সরকার ॥ আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে সরকার। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর এলাকার রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজ পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় তিনি জানান, রসিদের মাধ্যমে আলু বিক্রির বিষয়টি মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেখবেন। মজুতদাররা এই দামে আলু বিক্রি না করলে প্রশাসন এ দামে আলু বিক্রি করে যার আলু তাকে টাকা দেবে। তার আশা, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি ঠিক হবে। সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হবে।
এ ছাড়া রবিবারও ঢাকার বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে অধিদপ্তর। আলুর বাজার মনিটরিংয়ে স্থানীয় প্রশাসনকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে গত দুদিন ধরে হিমাগারে কোনো পাইকারি ক্রেতা আসছেন না বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীরাও কোনো আড়তে আলু পাঠাচ্ছেন না। এতে করে বাজারে আরও সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার নির্ধারিত দাম বাজারে কার্যকর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে আবারও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।