জীবনযুদ্ধে এখন কেবলই হতাশা। ভবিষ্যত গড়তে সঞ্চয় দূরে থাক, দৈনন্দিন জীবন চালানোই কষ্টসাধ্য। মূল্যস্ফীতির অসহনীয় চাপে জনজীবন বিপর্যস্ত। কারণ ব্যয়ের অনুপাতে বাড়ছে না আয়। উল্টো চাকরিহারা কিংবা সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। তাই সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে। যাদের সঞ্চয় নেই তারা চলছেন ধারদেনা করে। আয়-ব্যয়ের টানাপড়েনের কারণে ভাটা পড়ছে ব্যাংক আমানতে। এতে ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট।
দিন দিন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয় হচ্ছে বেশি। আর নতুন চালু হওয়া জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে আগ্রহ নেই মানুষের। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার পরও প্রথম মাসে হতাশাজনক আমানত সংগ্রহ হয়েছে। এ কর্মসূচির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচিত প্রবাস স্কিমে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। সংসারের খরচ ও আত্মীয়-স্বজনকে ধারকর্জ দিয়ে সঞ্চয়ের সুযোগ থাকছে না প্রবাসীদের। এমন প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যত প্রজন্মের সুরক্ষায় সঞ্চয় করতে না পেরে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনে খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। শুধু সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। বাস্তবে এটি আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার মান খারাপ হচ্ছে। সংসার চালাতে বেশ বিপাকে পড়ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ভোগ কমিয়ে হাতের বাড়তি টাকা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন, কেউ জমানো সঞ্চয় ভেঙে খরচ মেটাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, ভাঙা পড়েছে তার চেয়ে তিন হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকাও ঋণ পায়নি। অথচ অর্থবছরটিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি হয় ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। ফলে পুরো অর্থবছরে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ঋণাত্মক— তিন হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আরিফের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। বড় মেয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ও ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। নিজের আয় দিয়ে দুই মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এবার ব্যবসাও তেমন ভালো হচ্ছে না। তাই পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে দেন তারা। মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সন্তানের পড়াশোনা তো দূরের কথা ঢাকা থাকতে পারব কি-না জানি না। সামনে বেচাবিক্রি ভালো না হলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। চলে যেতে হবে গ্রামের বাড়িতে। এখন সঞ্চয়পত্র ভেঙে লাভ হচ্ছে না লোকসান হচ্ছে সেদিকে তাকানোর সময় নেই, আগে বাঁচতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় মানুষের হাতে রেকর্ড পরিমাণ নগদ টাকা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে নগদ টাকার মজুত বাড়ছে। অর্থাৎ যে টাকা ব্যাংকে জমা থাকার কথা ছিল ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তা এখন মানুষের হাতে হাতে রয়েছে। সর্বশেষ হিসাব মতে, নগদ টাকার রেকর্ড হয় গত জুন মাসে। চলতি বছরের জুন শেষে মানুষের হাতে ছিল তিন লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মানুষের সঞ্চয় কমে যাওয়ার আরও একটি সূচক লক্ষণীয়। গত জুলাই মাসে ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে আমানত কমে এক লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা জুন মাসে ছিল এক লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ কেবল সঞ্চয়ী হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মানুষের জমা কমেছে আট হাজার কোটি টাকা।
এদিকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর এক মাস পূর্ণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত ১৭ আগস্ট দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেন। অনেক প্রচারণা সত্ত্বেও স্কিমটি চালুর প্রথম মাসে মাত্র ১২ হাজার ৯৭২ জন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ সময়ে টাকা জমা পড়েছে সাত কোটি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শুরুতে চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’ এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’ শীর্ষক কর্মসূচি চালু করা হয়। এই চার কর্মসূচির মধ্যে কিছুটা সাড়া পাওয়া গেছে প্রগতি কর্মসূচিতে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেসরকারি চাকরিজীবীদের এই কর্মসূচির জন্য ছয় হাজার ১৭৮ জন চাঁদা পরিশোধ করেছেন। পরের অবস্থানে আছে সুরক্ষা কর্মসূচি। এক মাসে চার হাজার ৯৯০ জন এই কর্মসূচিতে নাম লিখিয়েছেন। সমতা কর্মসূচির জন্য চাঁদা পরিশোধ করেছেন এক হাজার ৩২৬ জন। আর সবচেয়ে কম সাড়া পড়েছে বিদেশে বাস করেন এমন বাংলাদেশিদের কর্মসূচি প্রবাসের ক্ষেত্রে। মাত্র ৩৯৫ জন এই পেনশন কর্মসূচিতে চাঁদার কিস্তি দিয়েছেন। এ স্কিমের আওতায় সরকারি চাকরিজীবী ব্যতীত দেশের সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ কারও বয়স ১৮ বছরের বেশি হলেই এখন অনলাইনে এই স্কিমে নিবন্ধন করতে পারছেন।
হাবিবুর রহমান নামে এক সৌদি প্রবাসী বলেন, ‘বেতন যা পাই তা দিয়ে এখন সংসার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ সব খাতে খরচ বেড়েছে। ওভারটাইম করে যা আয় হয় তাও মায়ের চিকিৎসা ব্যয় এবং আত্মীয়স্বজনকে ধারকর্জ দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক আশা ছিল সরকারের নতুন উদ্যোগ পেনশন স্কিমে বিনিয়োগ করব। কারণ সন্তানের ভবিষ্যৎ আছে। শেষ জীবনে আর্থিক নিশ্চয়তা দরকার। কিন্তু টাকা জমানোর সুযোগ কই। দৈনন্দিন খরচ মেটানোই এখন কঠিন। সন্তানের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে গত জুন মাসে পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলাম; মায়ের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করতে হয়েছে।’
অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে, ফলে কোনো ধরনের সঞ্চয় কর্মসূচিতেই তারা অংশ নিতে চাচ্ছেন না। কারণ কিস্তি দিতে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে এক ধরনের চাপ তৈরি হবে।’ তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির রুখতে না পারলে মানুষের জীবনমানের অবনতির পাশাপাশি সঞ্চয় কমে যাবে। তাই অনেকের মধ্যে ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা কাজ করতে পারে। যা ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনবে।’