সরকারি টেন্ডারে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসন ও ঠিকাদারদের যোগসাজশ ভাঙতে চালু হয়েছে অনলাইনভিত্তিক সরকারি ক্রয় কার্যক্রম বা ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি)। কিন্তু ওই যোগসাজশ রয়েছে বহাল তবিয়তে। একক টেন্ডারে কাজ পাচ্ছেন ঠিকাদাররা। মাত্র ৫ শতাংশ ঠিকাদারের হাতে রয়েছে ৩০ শতাংশ কাজের নিয়ন্ত্রণ। আর এতে দুর্নীতির ঝুঁকি বাড়ছে। তবে ই-জিপিতে দাপ্তরিক খরচ ও সময় কমেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চিত্র।
গতকাল সোমবার সংস্থার ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে ই-সরকারি ক্রয়: প্রতিযোগিতামূলক চর্চার প্রবণতা বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণায় ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ই-জিপি কার্যক্রম আমলে নেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ঠিকাদারদের বাজার দখলের প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, যে কারণে ভালো উদ্যোগের ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ই-জিপি বাস্তবায়নের বয়স প্রায় এক যুগ হলেও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। ই-জিপিতে যেসব ঠিকাদার রয়েছেন, তাদের মাত্র ৫ শতাংশের হাতে ৩০ শতাংশ কাজের নিয়ন্ত্রণ। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসন ও ঠিকাদারদের যোগসাজশ ভেঙে দিয়ে দুর্নীতি রোধের যে লক্ষ্য ই-জিপিতে ছিল তা খুব একটা কাজে আসেনি।
গবেষণা তথ্য বলছে, ই-টেন্ডারে সম্পাদিত কাজের ৯৯ শতাংশের দরপত্র মূল্য ২৫ কোটি টাকার নিচে। অর্থাৎ বড় চুক্তিমূল্যের দরপত্র এখনও পুরোপুরি এ প্রক্রিয়ার আওতায় আসেনি। সরকারি ই-কেনাকাটায় প্রতিযোগিতা ও একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা চিহ্নিত করতে গবেষণায় ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৩টি ক্রয়াদেশ বিশ্লেষণ করা হয়। টিআইবি বিশ্লেষণ বলছে, সরকারের ই-ক্রয় কার্যক্রমে ১০০টির মধ্যে ৪৬টিতে দরপত্র পড়ে ৪টির কম। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এই হার ৬৫ শতাংশ, যা ক্রয় প্রক্রিয়ায় কম প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, একক দরপত্রে কাজ পাচ্ছেন অনেক ঠিকাদার। পৌনে ২০০ কোটি টাকার কাজও একক দরপত্রে পেয়েছে ‘পদ্মা অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর আজিমপুর কলোনিতে ১৭৬ কোটি ১৯ লাখ টাকায় দুটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ পায় একক দরপত্রে। এভাবে একক দরপত্রে ১০০ কোটি টাকার বেশি দরে কাজ পাওয়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হলো– পদ্মা অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, মেসার্স আমানত এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, মেসার্স কোহিনূর এন্টারপ্রাইজ এবং এম জামাল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড।
গবেষণা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-জিপিতে একক টেন্ডারে কাজ দেওয়া যাবে না– এমন কথা নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন– নির্দিষ্ট মডেলের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে একক টেন্ডার হতে পারে। কিন্তু ভবন তৈরির ক্ষেত্রে একক টেন্ডারে কাজ দিলে বা কোনো একটি দপ্তরের প্রায় সব কাজ একক টেন্ডারে একই প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর পেতে থাকলে সেখানে দুর্নীতির আলামত দৃশ্যমান হয়। এমন ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান তা খতিয়ে দেখতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের ই-ক্রয় প্রক্রিয়ায় একক দরপত্র পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। ২০১২ থেকে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬০ হাজার ৬৯ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে একক দরপত্রে। সরকারের ৯২টি ক্রয় প্রতিষ্ঠানে একক দরপত্রের হার ৭৫ শতাংশের বেশি এবং ৪১৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের ৭৫ শতাংশ পেয়েছে একক দরপত্রে। ফেনী ও নোয়াখালীতে একক দরপত্র সবচেয়ে বেশি। এই দুই জেলায় প্রতি দুটি কার্যাদেশের একটি একক দরপত্রে।
টিআইবির গবেষণা বলছে, সিটি করপোরেশনের মধ্যে একক দরপত্রে (ই-জিপি পদ্ধতি) সবচেয়ে বেশি কাজ দিয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রতি তিনটি কাজের দুটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতি দুটি কাজের একটি একক দরপত্রে হয়েছে। গত প্রায় ১২ বছর ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রায় ৬৩ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় ৫৫ শতাংশ কাজের ক্ষেত্রে একটি করে দরপত্র পড়ে। অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠান দরপত্র দিয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানই কাজ পেয়েছে।
অন্যদিকে ই-জিপিতে অনেক প্রতিষ্ঠান শতভাগ কাজ দিয়েছে একক দরপত্রে। যেমন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হোসেনাবাদ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৫টি কাজের সব পেয়েছে মেসার্স খালেক এন্টারপ্রাইজ। একই মন্ত্রণালয়ের চুয়াডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২২টি কাজের ২১টি পেয়েছে মেসার্স ঢাকা মেটাল অ্যান্ড মেশিনারিজ স্টোর। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এলআরআই) কুমিল্লার ২৪টি কাজের ২২টি পেয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
শীর্ষে স্থানীয় সরকার
ই-জিপিতে কেনাকাটার শীর্ষে যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ রয়েছে, তাদের মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের অবস্থান প্রথম। তাদের কার্যাদেশের ৪৪ শতাংশ এবং চুক্তিমূল্যের ৪১ শতাংশ ই-জিপিতে হয়েছে। ই-জিপির মাধ্যমে ৯৩ শতাংশ ক্রয় হচ্ছে মাত্র ১০টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে। ই-জিপি চালুর ১২ বছর হতে চললেও অনেক কেনাকাটা এখনও এই পদ্ধতির বাইরে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ই-জিপি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে শুরু হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য সরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক ক্রয় নিশ্চিত করা। ই-জিপির ফলে ক্রয়প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে এবং ব্যয় কমেছে। তবে দরপত্র জমা ও কার্যাদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাজার দখল ও একচেটিয়াকরণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ই-জিপির মূল লক্ষ্য অর্থাৎ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বনিম্ন মূল্য ও সর্বোচ্চমান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি।
টিআইবির সুপারিশ
ই-জিপি সঠিকভাবে বাস্তবায়নে ছয়টি সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ই-জিপির আওতার বাইরে থাকা উচ্চ চুক্তিমূল্যের সব দরপত্র দ্রুততার সঙ্গে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনা প্রয়োজন। সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে আরোপিত মূল্যসীমা প্রত্যাহার হওয়া দরকার। সীমিত দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণের বর্তমান ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। পাশাপাশি একক দরপত্রপ্রবণ ক্রয় অফিসগুলো নজরদারিতে আনা দরকার। তা ছাড়া সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন। স্বচ্ছ, জবাবদিহিপূর্ণ, পক্ষপাতহীন, প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ই-জিপির মাধ্যমে তৈরি হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করার মাধ্যমে পুরো ক্রয়ব্যবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার সুপারিশ করেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন একই বিভাগের কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।