ভিসানীতির চাপে চাঙ্গা আন্দোলন

ভিসানীতির চাপে চাঙ্গা আন্দোলন

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের ওপর একটি বড় চাপ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটি আন্দোলন কর্মসূচি আরো জোরালো করে এই চাপকে ঘণীভূত করতে চায়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে রোডমার্চসহ চলমান ঘোষিত কর্মসূচি পালন শেষে ঢাকায় লাগাতার আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি ।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করায় সরকার দেশে-বিদেশে চাপে পড়েছে। সরকারি দলের নেতারাও এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। নেতারা এও বলছেন, সরকার যদি এত কিছুর পরেও একতরফা একটি নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে।

 

সরকারের পদত্যাগের দাবির পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও মুক্তি ইস্যুকেও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছে বিএনপি। এই ইস্যুতে দলের পক্ষ থেকে শক্ত কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।

গত ১২ জুলাই থেকে এক দফার আন্দোলন শুরু করা বিএনপি এখন ঢাকাসহ দেশব্যাপী পনের দিনের কর্মসূচি পালন করছে, যা আগামী ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোডমার্চের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এরপর দাবি আদায়ে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা দলটির। যা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়ার কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্য অক্টোবরে আন্দোলনকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাদের। ঢাকায় তখন নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থানের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। সাথে আসতে পারে হরতালও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা আলাপকালে বলেছেন, মার্কিন ভিসানীতি কার্যকর একটি বড় পদক্ষেপ। তবে আন্দোলন সফল করতে হবে রাজপথে কর্মসূচির মধ্য দিয়েই। সে পথেই এখন বিএনপি অগ্রসর হচ্ছে।

এ দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে বেগম জিয়া বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া লিভার জটিলতায় ভুগছেন। এ ছাড়াও তিনি ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনেই খালেদা জিয়া চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেছেন, বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ম্যাডামের লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সে জন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি সেন্টারে পাঠানো দরকার। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্যারামিটার আবারো বাড়ছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঘন ঘন নিতে হচ্ছে সিসিইউতে। আবার কাজ শেষে কেবিনে আনা হচ্ছে। এখন লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনো চিকিৎসা নেই। আর তা দেশে সম্ভব নয়। এই চিকিৎসক আরো বলেন, সিসিইউতে ম্যাডামের ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। লিভার সিরোসিসের কারণেই খালেদা জিয়ার ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে। পরে তা বের করা হচ্ছে। ইলেকট্ররাল ইমব্যালেন্স হওয়ায় শরীরে দুর্বলতা রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার খালেদা জিয়ার ফুসফুস থেকে পানি অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তার আল্ট্রাসনোগ্রামও করা হয়।

দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এ ইস্যুতে সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদনও করেছে বেগম জিয়ার পরিবার। তবে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাননি তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্ত ও আদালতের কথা বলা হয়েছে। তাই খালেদা জিয়া ইস্যুতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে শক্ত কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কথা ভাবা হচ্ছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুইজন নেতা বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ইস্যুতে শক্ত কর্মসূচি দিতে কেন্দ্রের ওপর দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। তাই এবার শক্ত কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর দাবিতে গত রোববার ঢাকাসহ দেশব্যাপী মহানগর ও জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। সমাবেশ থেকে অসুস্থ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

এই আল্টিমেটামকে ‘খুবই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত’ বলে মনে করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সাড়া পাওয়া না গেলে দলের মহাসচিব পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মসূচি তো নতুন মোড় নিতে বাধ্য। গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশা ও দেশের জনগণের প্রত্যাশা যখন গোয়ার্তুমির মাধ্যমে সরকার প্রত্যাখ্যান করছে, তখন কর্মসূচিও সঙ্গতকারণেই বড় ধরনের মোড় নেবে। তবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে সেই মোড় হয়তো একটু আগেই নিচ্ছে।

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ