বিভিন্ন কর্মসূচির পর পাল্টাপাল্টি আল্টিমেটাম নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে অনিশ্চয়তা

বিভিন্ন কর্মসূচির পর পাল্টাপাল্টি আল্টিমেটাম নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে অনিশ্চয়তা

দিন যত যাচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হলে সে নির্বাচন হবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। কিন্তু এতেই যত আপত্তি বিএনপি-জামায়াতসহ রাজপথে থাকা বিরোধী দলগুলোর। তারা বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

 

অন্যদিকে সরকারপক্ষ বা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক অনেক দেশেই দলীয় সরকারের অধীনে ভোট হয়, এ কারণে বাংলাদেশেও তেমনই হবে। নির্বাচন আসলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে, নাকি দলীয় সরকারের অধীনে হবে— এ নিয়েই বিরোধ বিএনপি ও তার মিত্র এবং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের মধ্যে। বছরের পর বছর ধরেই এ বিরোধী চলে আসছে। কিন্তু এর কোনো শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান হয়নি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা নির্বাচন পদ্ধতি এবং নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে— তা নিয়ে স্থায়ী সমাধান চাইলেও কার্যত তাদের সেই চাওয়া পূরণে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে এ একই ইস্যুতে বিরোধ থেকেই যাচ্ছে। আর নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন এই বিরোধ তীব্র হয়; এ নিয়ে সংঘর্ষ হয়, হয় সংঘাতও। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। দীর্ঘ এ বিরোধীয় বিষয়টির আসলে ঠিক কী ধরনের সমাধান হবে বা আদৌ হবে কি না, বিষয়টি নিয়ে কেউ নিশ্চিত নন।

সম্প্রতি বিএনপি ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে তৎপরতা শুরু করেছে। তাদের কর্মসূচি ঘোষণার পরদিন আওয়ামী লীগও ১২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে রয়েছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থেকে দেয়া হচ্ছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও। দেয়া হচ্ছে পাল্টাপাল্টি আল্টিমেটামও। সম্প্রতি বিএনপির অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতা একই সমাবেশ থেকে তাদের দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। এর পরদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে ‘সঠিক পথে আসতে’ ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দেন। অর্থাৎ নিজেদের জনসমর্থন জানান দেয়ার পাশাপাশি দলগুলোর বক্তৃতায় হুমকি-পাল্টা হুমকি দিচ্ছে একে অপরকে। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতেই দলগুলোর মধ্যে এখন যত বিরোধ চলছে। সরকার ও বিরোধী দল এই ইস্যুতে যার যার অবস্থান থেকে এক চুলও নড়ছে না। ফলে এ বিরোধের সমাধান কোন পথে মিলবে— সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে ‘সঠিক পথে আসতে’ ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দি ন  বলেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সংবিধানে যা যা বলা আছে, সেভাবেই নির্বাচন হবে। এ বিষয়ে দুটি দলই রাজপথে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে অবস্থান করছে। এ পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, কেউ যদি ইচ্ছে করে ঝগড়া করতে আসে, তাহলে তো কিছু বলার নেই, পরিস্থিতিই বলে দেবে কী হবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়লুন আবেদীন ফারুক মনে করেন, এখন আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া বিএনপির মাথায় অন্য কিছু নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশই হচ্ছে ‘এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়া যাবে না, সুযোগ নেই।’ সে কারণে যতদিন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট দেয়ার সুযোগ তৈরি না হবে, ততদিন পর্যন্তই মাঠে আছে বিএনপি। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই করছি আমরা। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনের ধরন কখন কী হবে, তা মাঠের কার্যক্রমই বলে দেবে। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ভোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট অনুষ্ঠানে আন্দোলন করছে বিএনপি— বলছিলেন দলটির চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা।

‘এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়া যাবে না, সুযোগ নেই।’ সে কারণে যতদিন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট দেয়ার সুযোগ তৈরি না হবে, ততদিন পর্যন্তই মাঠে আছে বিএনপি।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন  বলেন, নির্বাচন ইস্যু নিয়ে নতুন কোনো আলোচনা নেই। মাঝামাঝি কোনো অবস্থানও নেই। সংবিধানের আলোকেই ভোট হবে। এর বিকল্প কোনো চিন্তা নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাম্পাদক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। নিজেরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করতে হবে। এক টেবিলে বসতে হবে। আলোচনায় বসেই সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তার এই মনোভাবের কথা জানান। তিনি বলেন, দেশের সদস্যা দেশের কর্তাদেরই সমাধান করতে হয়। বিদেশি বন্ধুরা আমাদের কোনো সমস্যা দেখলে তারা পরামর্শ দিতে থাকেন; কিন্তু সমস্যার সমাধান তো আর তারা করে দেবে না, তা আমাদেরই করতে হবে।

নির্বাচন ইস্যু নিয়ে নতুন কোনো আলোচনা নেই। মাঝামাঝি কোনো অবস্থানও নেই। সংবিধানের আলোকেই ভোট হবে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়েছে। এসব তো ডিপ্লোম্যাটিক পদক্ষেপ। তারা সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠানে তাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে ভালো কোনো লক্ষণ দেখছেন না এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তার মতে, বিরোধীয় দুটি পক্ষ থেকে এক টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। এটা না করা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে, ভয়াবহ হবে। যা কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়েছে, আরও কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে চলমান সংকট সমাধান করা জরুরি। যারা স্যাংশনের আওতায় পড়ছেন, তাদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে বলেও মন্তব্য করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।

বিরোধীয় দুটি পক্ষ থেকে এক টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। এটা না করা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে, ভয়াবহ হবে।

তিনি বলেন, স্যাংশনের কারণে শুধু বিশেষ দল বা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সাধারণ মানুষ। তাই যারা মানুষের জন্য রাজনীতি করেন, মানুষের ভালো চান, তাদের উচিত বিরোধীয় ইস্যুগুলো সমাধানে এক টেবিলে মিলিত হওয়া।

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ