ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহ-কৌতূহল দীর্ঘদিনের হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উন্নয়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া ও ভারত যার যার মতো করে বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার নানামুখী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিশ্বের কতিপয় রাষ্ট্রের নানা হিসাব-নিকাশ এক্ষেত্রে কাজ করছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। দেশটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের ভিসা দেওয়া হবে না মর্মে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। মূলত এ ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি সামনে আসে, যা দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-২০-এর শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সাক্ষাৎ-আলাপচারিতার পাশাপাশি বাইডেন নিজেই সেলফি তোলার মাধ্যমে একটি মনোরম পরিবেশ উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সেলফি তোলার এ দৃশ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। এ ছবিটি দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী একাধিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির জি-২০ সম্মেলনের লাইভ কাভারেজে এ সেলফি পোস্ট করে লেখা হয়েছে, আমাদের ধারণা বিশ্ব নেতারাও এ সেলফি সংস্কৃতির প্রভাব এড়াতে পারেন না। ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তোলা সেলফি পোস্ট করে এর ক্যাপশনে লিখেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের ভেন্যুতে সেলফি তোলার দারুণ এক মুহূর্ত ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত সর্বত্রই এ সেলফি আলোচনার ঝড় বইছে। একটি সেলফি কি পুরো রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জো বাইডেন সেলফি তুলেছেন বলেই কি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অন্যান্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে যাবে বা তারা কি তাদের এতদিনের অবস্থান থেকে সরে আসবে? তাদের ভিসানীতি কি বদলে যাবে? এমন নানা প্রশ্ন সবার মনে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিজ্ঞজনদের মতে, একটা সেলফিতেই বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব রাতারাতি বদলে যাবে, এমনটা মনে করার কোনো যুক্তি নেই। তবে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে নেই’ বা ‘সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র’ বলে বিরোধী দল যে প্রচারণায় তৎপর ছিল, এই সেলফি সে ধারণার পালটা বার্তা তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। কারণ সেলফি শুধু একটি ক্লিক নয়, দুই নেতার অনন্য অভিব্যক্তি। রাতের খাবার অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা, জো বাইডেন ও নরেন্দ্র মোদির দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রাণবন্ত ছবি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সামনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলার ছবিসহ শীর্ষ সম্মেলনের আরও বেশকিছু ছবি প্রমাণ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিশ্বনেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এবং বাংলাদেশ এখন সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গুজব চলাকালে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতাদের এমন ছবি আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেলফির বিষয়টি অবশ্যই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে।
তবে একটি সেলফিই যে আগামী দিনের নির্বাচনি রাজনীতির মূল অনুঘটক হিসাবে কাজ করবে, সেটিও মনে করার তেমন উল্লেখযোগ্য কারণ নেই। এ সেলফি প্রমাণ করেছে দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ আলোচনা, উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, সম্মান জানানোর বিষয়টি। ছবিতে যে হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশ দেখা গেছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং শেখ হাসিনা-বাইডেনের সেলফি কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবেশ অনেকটাই বদলে দেবে। ভিসানীতিসহ বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না, সেটা অনেকেই ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ তথা সরকারের পরীক্ষিত বন্ধুত্ব নিয়ে চলমান নানা আলোচনার ব্যাপারেও উচিত জবাব দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পক্ষান্তরে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দিয়েছেন।
কূটনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যে ছবি গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে জো বাইডেন শেখ হাসিনার হাতকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন, যা উষ্ণ সম্পর্কের অনুপম অভিব্যক্তি। কূটনীতিতে করমর্দনকে উষ্ণ বা শীতল শরীরী ভাষার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হয়। আলতোভাবে বা দৃঢ় করমর্দন দিয়েও একজন নেতা আরেকজনের প্রতি তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রায় দেড় ঘণ্টা আন্তরিকতাপূর্ণ ও ফলপ্রসূ বৈঠক এবং পরদিন বাইডেন ও শেখ হাসিনার সেলফি, আন্তরিক আলাপ, জো বাইডেনকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো এবং বাইডেনের সে আমন্ত্রণ গ্রহণ ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে চলমান ধারণা পালটে যাওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহী।
ভারতের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ী গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে কূটনীতি কাভার করি। ফলে আমি জানি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা শরীরী ভাষা, করমর্দন, কে কোথায় বসল এগুলোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠক দেখছি। আজকের দিনে এ ধরনের ডিপ্লোম্যাসির সফ্ট-অ্যাঙ্গেল ধরুন চীন ও আমেরিকার মধ্যে বরফ গলল নিক্সন পিংপং ডিপ্লোম্যাসি। গঙ্গা চুক্তির আগে শেখ হাসিনা জ্যোতিবসুকে ১ হাজার টন ইলিশ পাঠিয়েছিলেন। সেটা আমাদের এখানে হিলশা ডিপ্লোম্যাসি। এখন সেলফি ডেপ্লোম্যাসি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবি তোলাটা এটা সাধারণ কোনো আলোকচিত্র তুলছেন তা নয়; প্রেসিডেন্ট বাইডেন, আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রপতি, তিনি বাংলাদেশের শেখ হাসিনাকে ভয় পেয়ে সেলফি তুলে দেবেন ব্যাপারটা তা নয়। আমি কার সঙ্গে সেলফি তুলি? যাকে আমি পছন্দ করি; যে আমার বন্ধু। ছবি একটা ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার যা ঘটেছে তা মিটে গেছে বা মিটে যাচ্ছে আমি এমনটা বলব না। আমি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। তবে এটা সূত্রপাত ঘটেছে। আমি অনেককে আগেই বলেছি। ভারত আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ রকমভাবে কেউ যেন না ভাবেন ভারত আমেরিকাকে ধমকাচ্ছে। চীনের কারণে ভারতের আমেরিকাকে প্রয়োজন। আর ভারতের নিজস্ব স্বার্থে প্রায়োজন বাংলাদেশকে। যে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের মানুষ যাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন তারই সঙ্গে চিরন্তন ধারাবাহিক সম্পর্ক রাখবে ভারত।…সেই কারণে ভারত সম্ভবত আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সম্পর্ক ভালো হোক; ভারত হয়তো সেই সূত্র ধরে কাজটা করছে। যে যাই বলুন, আমার কাছে এ সেলফি তোলার ব্যাপারটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গেম চেঞ্জার মনে হয়।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ অসাধারণ সেলফি কূটনীতি দেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় নির্মাণ করবে কিনা, তা স্পষ্ট না হলেও ভাইরাল হওয়ার পর থেকে এটি রাজনীতিতে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে নানারকম মুখরোচক বক্তব্য-বিবৃতি অব্যাহত রেখেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিজেদের মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছেন। বাইডেনের সেলফিকে বর্তমান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয়তা হিসাবে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারদলীয় নেতাদের দাবি, নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল বিদেশি চাপের যে জুজুর ভয় দেখাতে শুরু করেছিল, তাতে পানি ঢেলে দিয়েছে জি-২০ সম্মেলন। দিল্লির এক সেলফিতেই বিরোধীদের রাতের ঘুম হারাম, চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে ইত্যাদি বক্তব্যে সরকারি দলের চাঙাভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়