দূষণে প্লাস্টিক এক অভিশাপ

দূষণে প্লাস্টিক এক অভিশাপ

রাজধানীতে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ আকারে বাড়ছে প্লাস্টিকের বর্জ্য। ঢাকার মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে না পারলে অবস্থা আরও অবনতি হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়। এটির প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা চারপাশে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়। রাজধানীর ড্রেনগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্য অপচনশীল হওয়ার ফলে পানি চলাচলে বাধা হয়ে জলাবদ্ধাতার সৃষ্টি হচ্ছে। প্লাস্টিকের বিকল্প কিছু ব্যবস্থা ও তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান কখনো সম্ভব না।

প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ঢাকার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে হচ্ছে। পার্ক ও লেক, রাস্তার ধার, নদী ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্যের অবস্থান দেখা যায়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন এক কোটি ২০ লাখের বেশি পলিব্যাগ বর্জ্য বিভিন্ন লেক, ঝিল, পুকুর, ডোবা, নালা ও নদীতে গিয়ে জমা হচ্ছে। এতে করে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। একটি প্লাস্টিক বর্জ্য প্রায় ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে বিরাজ করে জীব ও প্রকৃতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বছরে একজন মানুষ প্রায় পাঁচ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে। ব্যবহূত পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হয়ে আমাদের আশপাশে অবস্থান করছে। যার ফলে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়।

বিশেষ করে ঢাকাতে আয়তনের তুলনায় বিপুল পরিমাণে জনসংখ্যা হওয়ায় প্লাস্টিকের ব্যবহারও বেশি। তাছাড়া অধিকাংশ স্থানে বর্জ্যের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় অনেকেই ফেলছে যেখানে সেখানে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ। প্লাস্টিকের মতো বর্জ্য বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালে বাংলাদেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন জারি করে। তবে কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই যত্রতত্র নির্বিচারে পলিথিন ব্যবহার চলছে। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উন্মুক্ত জায়গায় ফেলা হচ্ছে। এ ধরনের দূষণ বন্ধ করতে হলে প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করা জরুরি। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে প্লাস্টিকের অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্য মতে, প্রতিদিন দুই সিটিতে প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে প্লাস্টিকের বর্জ্য থাকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এসব বর্জ্যের ফলে অধিকাংশ জায়গায় পানি প্রবাহে বাধা তৈরি হয়। জলাবদ্ধতার কারণে চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। সিটি কর্পোরেশন সব স্থানে ময়লার ডাস্টবিন দেয়ার কথা বললেও তেমন কোথাও দেখা যায় না। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা ও রিসাইকেলিং করতে পারলে সমস্যার কিছুটা লাঘব হতো।

বায়ুদণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্য মতে, ঢাকায় দৈনিক ৬৮০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। তার মধ্যে ৬৮০ টন প্লাস্টিক বর্জ্যের উপস্থিতি থাকে। ব্যবহারের ৭০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য প্রকৃতিতে কোনো না কোনোভাবে থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া ৭০-৮০ টন বর্জ্য নদীতে গিয়ে পতিত হচ্ছে। যা নদীর পরিবেশকে নষ্ট করছে। ৬৮০ টন থেকে মাত্র ২০০ টনের কম রিসাইকেলিং করা হচ্ছে। যা শুধুমাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বর্জ্য রিসাইকেলিং করা হয়। ঢাকায় যতটুকু প্লাস্টিক ব্যবহার হয়, তা রিসাইকেলিং করতে না পারায় বেশি সমস্যা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন নিষেধ করা হলেও অগোচরে এখনো চলছে কার্যক্রম। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় নিয়মের বাইরে গিয়ে এসব পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। যেহেতু সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাই সিটি কর্পোরেশন ইচ্ছা করলেই ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তেমন কিছুই হচ্ছে না।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বের শীর্ষ দশমে রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর ব্যবহার তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে নালা ও খাল হয়ে নদীতে পড়ছে। সর্বশেষ ঠাঁই হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। নদী হয়ে সাগরে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে অবচেতন মনে অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ১০০ এর বেশি ফ্যাক্টরিতে এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়।

এই বিষয়ে জনতে চাইলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা এবং স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, প্লাস্টিক আমাদের তিন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন করে। এটি শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার তৈরি করে। মাটির উর্বরতা নষ্ট করার জন্য প্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি দায়ী। মাঝে মাঝে কিছু গাছ হঠাৎ করে পড়ে যায় শুধু প্লাস্টিকের মতো বর্জ্যের কারণে। নিচে প্লাস্টিক থাকায় শিকড় গভীরে ভেদ করতে পারে না। এটি যখন পুরোনো হয় তখন তিন ধরনের সমস্যা হয়। এর ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, বাতাসকে দূষণ করে ও পানিকে দূষণ করছে। এটির কারণে মৃত্তিকার সমস্যা খুব বেশি দেখা যায়। বেশি ক্ষতি করছে একক ব্যবহারের বর্জ্য। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ওয়ান টাইম গ্লাস ও প্লেট, পলিথিন এবং প্যাকেজিংয়ের বর্জ্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব বস্তু ব্যবহারে আমাদের বেশি সচেতন হতে হবে। তাছাড়া রিসাইকেলিং করার চিন্তা করতে হবে।

প্রতিকারের উপায় জানতে চাইলে কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, একবার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করা আইনগত নিষেধ রয়েছে। যদি অর্থ ও কারাদণ্ড ঠিক মতো প্রয়োগ করা হয় তাহলে এটি কমানো যাবে। এটির বিকল্প যা আছে সেগুলো মানুষের কাছে সুলভ, সহজলভ্য ও সহজ প্রাপ্য না। আমরা যদি কাপড়ের, কাগজের, পাটের ও পাতার কিছু তৈরি করতে পারি তাহলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো সম্ভব। কিন্তু এমন কিছু এখনো বাজারে আনা সম্ভব হয়নি। বাজারে টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার বাড়লেও এটিতেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। যদি বিকল্প কিছু মানুষকে দেয়া যায় তাহলে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটাই কমানো যাবে। প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারে ৪০ টাকা আর পরিবেশ বান্ধব ব্যাগ মাত্র তিন টাকা খরচের ব্যবস্থা করতে পারলে প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাস সম্ভব। প্লাস্টিক মূলত কাচ ও মেলামাইনের পণ্যের বিকল্প হিসেবে আমাদের মাঝে এসেছিল। যা এখন অভিশপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিকে বাদ দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো মানের কিছু আবিষ্কার করতে হবে। কারণ প্লাস্টিক হলো সহজ পরিবহনযোগ্য ও কম খরচে

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ