প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক
যুগ যুগ ধরে বৈশ্বিক গাড়িশিল্পে শীর্ষস্থানীয় এক নাম টয়োটা। শুধু গাড়িই নয়, গাড়ির যন্ত্রাংশের জন্যও জাপানের এই কোম্পানি অত্যন্ত সুপরিচিত। ৮৬ বছরের পথচলায় গাড়ি কোম্পানিটি স্বকীয়তা ও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের সড়কে যত ব্যক্তিগত গাড়ি দেখা যায়, তার বেশির ভাগই টয়োটা ব্র্যান্ডের।
বিজনেস ম্যাগাজিন ফরচুন–এর হিসাবে ২০২২ সালে রাজস্ব আয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি কোম্পানি ছিল জার্মানির ভক্সওয়াগন। এরপরের নামটিই হলো টয়োটা মোটর। আগের বছরে অবশ্য এই তালিকার শীর্ষেই ছিল টয়োটা। গত বছর ভক্সওয়াগনের মোট রাজস্ব আয় ছিল ২৯ হাজার ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা টয়োটার রাজস্ব আয় একই সময়ে ছিল ২৭ হাজার ৯৩০ কোটি ডলার।
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে টয়োটার রাজস্ব আয় ৯ শতাংশ ও মুনাফা ২০ শতাংশ বেড়েছে। নানা চড়াই-উতরাই পার করে আজকের এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে টয়োটা। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট সম্পদমূল্য প্রায় ৫৬ হাজার কোটি ডলার।
যাত্রা শুরু যেভাবে
টয়োটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সাকিচি টয়োডা ছিলেন জাপানের কোরোমো শহরের বাসিন্দা। তিনি তাঁতে রেশমি কাপড় তৈরি করতেন। তবে মনমানসিকতায় ছিলেন উদ্ভাবনী মানুষ। একসময় তিনি ভাবলেন, যন্ত্রচালিত তাঁত উদ্ভাবন করা গেলে কষ্ট অনেক কমবে। সেই ভাবনা থেকে একটি স্বয়ংক্রিয় তাঁতযন্ত্র বানিয়ে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের একটি কোম্পানির কাছে যন্ত্রটির স্বত্ব বিক্রি করে বিপুল অর্থ পান তিনি।
তাঁতযন্ত্র বিক্রির অর্থ বিনিয়োগ করেন গাড়ির ইঞ্জিন তৈরির কাজে। এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন ছেলে কিচিরো টয়োডা। ১৯৩৫ সালে কিচিরো প্রথম এ-ওয়ান মডেলের গাড়ির ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেন। সেই থেকে শুরু। এরপর ধারাবাহিক সফলতা ও ব্যবসায় বিকাশের গল্প। বদৌলতে গড়ে ওঠে টয়োটা গ্রুপ বা গোষ্ঠী, যাদের অধীনে রয়েছে ১৬টি বড় প্রতিষ্ঠান।
কিচিরো টয়োডা শুধু গাড়ির ইঞ্জিনই নয়, সম্পূর্ণ গাড়ি তৈরির কথাও চিন্তা করেন। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই ‘মডেল এএ’ গাড়ি নিয়ে আসেন বাজারে। পরের বছরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন টয়োটা মোটর করপোরেশন নামের গাড়ি কোম্পানি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৯০০–এর বেশি মডেলের গাড়ি বানিয়েছে কোম্পানিটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টয়োটার ব্যবসায়ে ব্যাপক ধস নামে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ধাক্কা কাটিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে জায়গা করে নেয় কোম্পানিটি। ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির মাধ্যমে গাড়ি রপ্তানি শুরু করে টয়োটা। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে টয়োটার গাড়ি বিক্রি হয়।
Advertisement
নামকরণ
টয়োটা নামটি এসেছে কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান মালিকদের পূর্বপুরুষ সাকিচি টয়োডার নামানুসারে। জাপানে সাকিচিকে বলা হয় উদ্ভাবকদের রাজা। শুরুর দিকে টয়োডা নাম ও প্রতীকে গাড়ি বিক্রি হতো। পরবর্তী সময়ে উচ্চারণের সুবিধার জন্য কোম্পানিটি নাম পাল্টে টয়োটা করে। একই সঙ্গে লোগোও পরিবর্তন করা হয়, যা এখনো রয়েছে। বর্তমান লোগোর মধ্যে থাকা টি প্রতীকটিও টয়োটা নামের প্রতিনিধিত্ব করে।
আরও যা যা আছে
গাড়ি তৈরিতেই থেমে থাকেনি টয়োটার উদ্ভাবনযাত্রা। একে একে গাড়ির মূল কাঠামো, ইস্পাত, যন্ত্রাংশ, ট্রেডিং কোম্পানি, গবেষণা কেন্দ্র ও আবাসন খাতে আলাদাভাবে বিনিয়োগ করে টয়োটা। দীর্ঘ পদযাত্রায় নতুন নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বড় অনেক প্রতিষ্ঠানও অধিগ্রহণ করেছে টয়োটা গ্রুপ। যেমন ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জাপানের অন্যতম পুরোনো অটোমোবাইল ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক ডাইহাতসুকে তারা ২০১৬ সালে কিনে নেয়। আবার ট্রাক ও বাস তৈরির জন্য বিখ্যাত হিনো কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে ২০০১ সালে।
এর বাইরে দেশে–বিদেশে ১৫টির বেশি কোম্পানিতে আংশিক শেয়ার রয়েছে টয়োটার। এই তালিকায় মাজদা, সুজুকি, ইসুজু, ইয়ামাহা, প্যানাসনিক ইলেকট্রনিকসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি টেসলাতেও প্রায় ৩ শতাংশ শেয়ার ছিল টয়োটার। তবে ২০১৬ সালের শেষ দিকে তা বিক্রি করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
গাড়ি তৈরির পরিসর
বেশি ও কম দামি উভয় ধরনের গাড়িই তৈরি করে টয়োটা। মূলত ছোট আকারের ও সাশ্রয়ী গাড়ি দিয়েই কোম্পানিটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। টয়োটা বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশ ও সংস্কৃতি বিবেচনায় রেখেই পৃথক মডেলের গাড়ি তৈরি করে। বিশেষ করে জ্বালানিসাশ্রয়ী হাইব্রিড ইঞ্জিনের গাড়ি তাদের জনপ্রিয়তাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে টয়োটার গাড়ি কারখানা রয়েছে ৬০টির বেশি। এ ছাড়া ২০টি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র এবং ৫টি আঞ্চলিক সদর দপ্তর রয়েছে। টয়োটার সবচেয়ে বড় কারখানাটি অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যে। কারখানাটির বছরে সাড়ে ৫ লাখ গাড়ি ও ৬ লাখের বেশি ইঞ্জিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। প্রতিবছর এক কোটির বেশি গাড়ি তৈরি করছে টয়োটা। এসব গাড়ি বিক্রি করে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলার মুনাফা করে কোম্পানিটি। টয়োটাতে বর্তমানে ৩ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন।
তবে সব সময়েই নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই গেছে টয়োটা। বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে কোম্পানিটির যেমন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তেমনি এটি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জেও পড়েছে। যেমন ব্রেক চাপার পরেও গাড়ি থামতে কয়েক মুহূর্ত বিলম্ব হয়—এমন অভিযোগ ওঠে একবার। যে কারণে ২০২০ সালে সারা বিশ্ব থেকে তারা ৮০ লাখ গাড়ি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে বর্তমানে শুরু হয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগ। এ ধরনের গাড়ির প্রসারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে টয়োটার সাধারণ জ্বালানিতে চলা গাড়ির বিক্রি কমেছে। এ জন্য টয়োটাও বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
চাঁদেও যাবে টয়োটার গাড়ি
মহাকাশেও নিজেদের গাড়ি পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে টয়োটা। ২০৪০ সালের মধ্যে মানুষের চাঁদে বসবাস করার উপায় খুঁজছে বেশ কয়েকটি দেশের মহাকাশ সংস্থা। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাপানের মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে মিলে ‘লুনার ক্রজার’ নামে এসইউভি ধরনের একটি গাড়ি তৈরি করছে টয়োটা। বিশেষভাবে নির্মিত এ গাড়িতে বসেই নভোচারীরা কাজ করা, খাওয়া, ঘুমানোসহ অন্যান্য মৌলিক কাজ করতে পারবেন। ২০২৯ সালের মধ্যে এটি মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে টয়োটার।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ফরচুন, টয়োটা ক্লাব ও টয়োটা ইউরোপের ওয়েবসাইট