মহাসংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

মহাসংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

নিজস্ব প্রতিবেদক,

 

গ্যাসের অভাবে মহাসংকটে পড়েছে দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। মাত্র ৩৮ শতাংশ কেন্দ্র নিয়মিত উৎপাদনে থাকতে পারলেও খুঁড়িয়ে চলছে ২৯ শতাংশ। আর ৩৩ শতাংশ কেন্দ্র একেবারেই বন্ধ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ মোট কেন্দ্রের ৬২ শতাংশের অবস্থাই নাজুক। যে কারণে এসব কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট থাকলেও ২ হাজার ৭৮৯ মেগাওয়াট কমে এখন উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২২৮ মেগাওয়াটে। যে কারণে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দেশবাসীকে। অবশ্য শীত অত্যাসন্ন হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের উদ্ধৃত্ব থাকবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এই সময়টুকুতে চাহিদা কমে যাওয়ায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনিতেই নিষ্ক্রিয় থাকবে। যদিও সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে তাদের পেমেন্ট পাবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব না দেয়া এ সংকট তৈরি হওয়ার বড় কারণ। একই সঙ্গে ব্যয়বহুল এলএনজি-নির্ভরতা আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলছে জ্বালানি খাতকে।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষেজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘দেশীয় খাতে অনুসন্ধান, উত্তোলন না বাড়িয়ে কেন সরকার এলএনজি আমদানিতে ঝুকঁছে- এ তর্কটা আজকের নয়। আমরা সবসময় বলে আসছি, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের জোর দেয়া উচিত। কিন্তু তা না করে আমরা আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছি। এর কিন্তু একটা অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। দিনশেষে যা জনগণের ওপরই বর্তাবে।’

সংকটের মধ্যে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে এমন প্রশ্নে পিডিবির মুখপাএ শামীম হাসান বলেন, যখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন কিন্তু এ সংকট নিয়ে চিন্তা করা হয়নি। যেহেতু সংকটপূর্ণ অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেহেতু চেষ্টা করা হবে তা সমাধান করার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৬৪টি। কিন্তু গ্যাস সংকটে দীর্ঘদিন ধরে সক্ষমতার অর্ধেক বা আংশিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। অপরদিকে, পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে ২১টি। বর্তমানে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা দুই হাজার ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করছে অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ এক হাজার ৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। যে কারণে ক্রমান্বয়ে আমদানীনির্ভরতা বাড়ছে।

পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে শুধুমাত্র এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। এ সময়ে দেশের পুরো গ্যাস ক্রয়বাবদ ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অথচ মোট গ্যাসের মাত্র ২৪ শতাংশ পাওয়া যায় এলএনজি থেকে। কিন্তু ব্যয় করতে হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ গ্যাসের সমান দাম। আগামীতে আরও তিন গুণ এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাস সরবরাহের বেশির ভাগই আসে স্থানীয়ভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে। এর মধ্যে শুধু মার্কিন কোম্পানি শেভরন উত্তোলন করছে মোট গ্যাসের ৫০ শতাংশ। স্থানীয় কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৬ শতাংশ। শেভরনের গ্যাস ক্রয়ে বছরে ব্যয় হয় মাত্র ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থ। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পেছনে বছরে ব্যয় হয় ৫ শতাংশের কিছু বেশি। তবুও জ্বালানি বিভাগ নির্ভরতা বাড়াচ্ছে এলএনজি আমদানির দিকেই।

পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, সহসাই গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা নেই। এমন সংকটের সময়ও উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও পাঁচটি গ্যাসচালিত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র। নতুন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- এলএনজিভিত্তিক সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইউনিক গ্রæপের মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের মেঘনাঘাট ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র।

এ ছাড়া, ডুয়েল ফুয়েলভিত্তিক (গ্যাস বা ডিজেল) খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ১৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ঘোড়াশাল ইউনিট-৩ রিপাওয়ারিং বিদ্যুৎকেন্দ্র। সবমিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৩৭১ মেগাওয়াট।

তিতাস গ্যাস সূত্র জানায়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কারিগরি পরীক্ষার জন্য কেবল সামিট ও ইউনিকের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। ফলে কেন্দ্র দুটিতে বর্তমানে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বাকি কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাস সংকটে আমরা চলমান বা আগের কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখেছি। নতুন কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বোঝাটা আরেকটু বাড়ল। এখন যেটা করতে হবে, সবার থেকে একটু লোড কমিয়ে দিয়ে এদের চালাতে হবে। আর চালাতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। চুক্তিটা করা হয়েছে সেভাবে। সুতরাং যারা প্ল্যান্ট বানিয়েছেন তাদের তো চিন্তা নেই। চাপটা এখন সরকারের। এখন দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে গুরত্বারোপ করাটা জরুরি। যাতে আমাদের নিজস্ব নির্ভরতা তৈরি হয়।

তিতাসের মহাব্যবস্থাপক মো. সেলিম মিয়া বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন টেস্টিং পর্যায়ে রয়েছে। তাদের গ্যাস দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা আমাদের নেই। সামগ্রিকভাবে গ্যাসের সরবরাহ না বাড়লে তাদের গ্যাস দেয়া সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এখন তাদের গ্যাস দিতে হলে অন্যান্য প্ল্যান্ট থেকে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে। সেটি এখনই সম্ভব নয়। হায়ার অথরিটি থেকে নির্দেশনা পেলে করা হবে।

শীতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র: বিদ্যুৎ শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের মতে, আগামী শীতে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের পরিস্থিতি বাড়তে পারে এবং আগামী কয়েক মাসে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডে আরও বেশি বিদ্যুৎ আসবে এবং স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করতে পারে। সাধারণত শীত মৌসুমে প্রায় ৭০ শতাংশের মতো চাহিদা কমে যায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট (যার মধ্যে ৬২০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট ইতোমধ্যে গ্রিডে এসেছে), মেঘনাঘাটের রিলায়েন্স পাওয়ার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭১৮ মেগাওয়াট, এলএনজিভিত্তিক জিই-সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫৯০ মেগাওয়াট এবং মেঘনাঘাটে এলএনজিভিত্তিক ইউনিক গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এদিকে আদানি গ্রুপের এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট এবং রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৬২০ মেগাওয়াটসহ সম্প্রতি সম্পন্ন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরও বিদ্যুৎ ইতোমধ্যেই গ্রিডে এসেছে।

গত শীতে চাহিদা কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে নেমে এসেছিল। পিডিবির রেকর্ড অনুসারে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে উৎপাদন নয় হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট রেকর্ড করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাহিদা দ্রুত গতিতে না বাড়ায় আগামী শীতে উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে থাকবে। পিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যদিও ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিষ্ক্রিয় থাকবে, তবুও সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে তাদের পেমেন্ট পাবেন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশ বিদ্যুৎ খাতে সমস্যার দিকে ঝুঁকছে এবং এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলবে। বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গ্রীষ্মকালে ৫০ শতাংশ এবং শীতকালে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকলে দেশ এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কারণ বেসরকারি খাতের ক্যাপাসিটি পেমেন্টের চাপ বাড়তে থাকবে এবং প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি বাড়বে। এটি জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেবে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারকে প্রথমে স্বীকার করতে হবে চাহিদা বিবেচনা না করেই বেসরকারি খাতকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে ভুল করেছে এবং তারপর বর্তমান নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের চাপ আসছে বলে পরিস্থিতি সামলানো আরও কঠিন হবে। আর যদি তা করা হয়, তাহলে তা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ