আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেয়া ঋণ প্রতিশ্রুতির দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আজ বাংলাদেশে আসছে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল। তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে ১০টি প্রশ্ন রয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদের। এসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হবে কি-না।
আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে একাধিক বৈঠক করবে সংস্থাটি। সারাদিনই ব্যস্ত সময় পার করবেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। জানা গেছে, তারা বিভিন্ন টেকনিক্যাল বৈঠকে অংশ নেবেন। এদিন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। তার সঙ্গে থাকবেন ডেপুটি গভর্নররা। এছাড়া হেড অব বিএফআইইউ, চিফ ইকোনমিস্ট ও বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালকরা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বৈঠকে যোগ দেবেন। বিভিন্ন বিভাগের পরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তথ্য পর্যালোচনামূলক আলোচনায় অংশ নেবেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, বৈঠকে আর্থিক খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাতের সাম্প্রতিক কর্মক্ষমতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি, ঝুঁকি, নতুন প্রবিধান, জলবায়ু চাপ পরীক্ষা এবং অন্যান্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ও কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে পর্যালোচনা। এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গ্রস রিজার্ভ ডেভেলপমেন্ট, ব্যাংক সেক্টরের বিভিন্ন সমস্যা ও সুরক্ষা মূল্যায়ন সম্পর্কিত আলোচনা অগ্রাধিকার পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংস্কারের যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে, তার অগ্রগতি ও উন্নয়ন পর্যালোচনা করে দেখবে প্রতিনিধিদল। এক্ষেত্রে মুদ্রানীতি এবং বিনিময় হার, চলতি বছরের আর্থিক অ্যাকাউন্টের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে— তাও দেখা হবে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি, আমদানিতে বিধিনিষেধ ও রপ্তানি আয় বিলম্বে আসা বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করবে সংস্থাটি।
সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির বিষয়ে যেসব বিষয় প্রভাব বিস্তার করছে, তাও আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে থাকবে। এক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিময় হার বৃদ্ধি, মুদ্রানীতির বর্তমান অবস্থা, সুদহারের প্রভাবও দেখা হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণীত নতুন ইন্টারেস্ট রেট করিডোরের কার্যকারিতা নিয়েও আলোচনা হবে। এই নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর অগ্রগতি এবং নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও অপারেটিং টার্গেট অর্জনে স্মার্ট সুদহারের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন এবং শাসন কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য গত বছর আইএমএফের পক্ষ থেকে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তা কতটুকু কাজে এসেছে— সে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখবে প্রতিনিধিদল। তাছাড়া জলবায়ু সম্পর্কিত গ্রিন ফাইন্যান্স, সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স এবং গ্রিন বন্ড নীতির বাস্তবায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সংস্থাটির বেঁধে দেয়া শর্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ইতোমধ্যে ঋণের সুদহার ও মুদ্রাবিনিময় হারে সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও আইএমএফ রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণের শর্তে ছাড় দিতে চায় না।
সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের দেয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একটি মিশন আজ থেকে আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। সংস্থাগুলো হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
ঋণের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে আইএমএফ। সংস্থাটির পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি বছরের জুনে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকতে পারবে না। কিন্তু গত ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রস রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া সম্প্রতি প্রকাশিত চলতি বছরের জুনভিত্তিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া বিপুল প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আইএমএফের শর্ত ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকতে হবে। কিন্তু এই শর্তও পূরণ হয়নি। একইসঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তিন লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে আইএমএফ। এ ক্ষেত্রে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করেছে তিন লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। রিজার্ভ ধরে রাখা ও রাজস্ব আহরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন সরকারের সাবেক অর্থ সচিব ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে নতুন ফর্মুলা চূড়ান্ত করতে না পারাটা। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, তাই ফর্মুলা বাস্তবায়ন হচ্ছে না— এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় আইএমএফের কাছে। এটার পরিবর্তন জরুরি।
জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব আহমেদ জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে। এটি ফুলফিল করতে পারলে দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের অর্থ পেতে কোনো সংশয়ই থাকত না।
উল্লেখ্য, আইএমএফ চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ছাড় করে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৭০ কোটি ডলার ছাড় করার কথা রয়েছে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে তাদের দেয়া শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণেই ঢাকায় আসছে আইএমএফ মিশন। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেয়ার কথা আইএমএফের। এই ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।