সরকারকে চূড়ান্ত সতর্কসংকেত দিয়ে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত এক ডজন আল্টিমেটাম দিয়েও সফল হতে পারেনি দলটি। সর্বশেষ গত সপ্তাহে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার দাবিতে বিদেশযাত্রায় ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে সরকারকে। সেই আল্টিমেটামের প্রায় ২৫০ ঘণ্টা পার হলেও এখনো তার কোনো আলোর মুখ দেখেনি বিএনপি।
গত রোববার আইনি পথেও সরকার ‘না’ করে দেয় খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। এরপর থেকেই দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে সরকার খালেদা জিয়াকে হত্যা করতে চায়। তবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রশ্ন উঠেছে— সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপি কী করবে। দলটির হাইকমান্ড ও নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে— বিএনপির হাতে আর সময় নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। তার আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের তফসিল। তাই এর আগেই রাজপথ দখলের চিন্তা করছে দলটি। চলতি অক্টোবর থেকেই আন্দোলন জোরদারের চেষ্টা করছে তারা। পূর্বঘোষিত চলমান আন্দোলন কর্মসূচি শেষে আবারও এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ কর্মসূচি পালনের পর তারা ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিএনপির চলমান রোডমার্চ কর্মসূচি কাল ৫ অক্টোবর বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এসে শেষ হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান আগামী দুই সপ্তাহের কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে। এরপর ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে সরে যাওয়ার মতো শক্ত পথেও হাঁটবে দলটি।
বিএনপির রাজনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার পর রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে দলটি। বর্তমানে তাদের প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দেশের চিকিৎসকরা তার বিষয়ে প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন। এখন আর খালেদা জিয়ার শরীরে সব ধরনের ওষুধও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এর মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, খালেদা জিয়া বাঁচলে বিএনপি বাঁচবে। খালেদা জিয়ার কোনো অঘটন ঘটে গেলে বিএনপিও বাঁচবে না। খালেদা জিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে বিএনপিকে রাজনৈতিক পথেই হাঁটতে হবে। দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আমরা বোকার স্বর্গে বাস করেছিলাম। আমরা বুঝতেই পারিনি খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়ে মৃত্যুর উদ্দেশ্যেই সরকার আটক করেছিল। খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে আওয়ামী লীগকেও ছাড় দেয়া হবে না। তাই আগামী নির্বাচন আর খালেদা জিয়ার ইস্যু নিয়ে পিছু হটবে না বিএনপি। কূটনৈতিক যতটুকু ফায়দা হাসিল করার, তার সিংহভাগ অর্জন প্রায় হয়ে গেছে। এখন বাকি বিষয় রাজপথে কঠোর ভূমিকার মাধ্যমেই শেষ করতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর যেভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে সারা দেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থককে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ স্লোগান দিয়ে রাজধানীতে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন, এবারও ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়ে সেভাবে সবাইকে আসতে বলা হতে পারে। তাই এ মাসের শেষদিকে রাজধানীতে একটি বড় ধরনের মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। সারা দেশের সব জেলা-উপজেলা থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ঘটিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি থাকতে পারে। দলটি আশা করছে, এটিই এবারের আন্দোলনের চূড়ান্ত টার্নিং পয়েন্ট হবে।
রাজনৈতিক বিষয়ে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যারাই রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করতে পেরেছে, সে দলই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি থাকলেও বিএনপি এখনও সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারেনি। অবশ্য অতীতের হিসাবের সঙ্গে এবারের দ্বাদশ পলিসিতে কিছুটা ভিন্নতা ঘটছে। সময় কম থাকলেও বিএনপি তেমন চিন্তিত নয়। কঠোর আন্দোলনে এবার তারা আর চিন্তা করবে না। সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি পালন করবে দলটি। ঢাকামুখী আল্টিমেটাম, ঘেরাও কর্মসূচি, অবস্থান কর্মসূচিসহ সবকিছুই ধাপে ধাপে ঘোষণায় আসবে।
এ বিষয়ে জানতে বিএন?পির ভাইস চেয়ারম?্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, শুধু বিএনপি নয়, দেশের মানুষকে মুক্ত করতেই আমাদের রাস্তায় নামতেই হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হলে অস্থিরতাও বাড়তে পারে। সামনে আগানো ছাড়া বিএনপির আর কোনো পথ নেই। আপনারা দেখেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিষয়ে শেখ হাসিনা কী কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, এটা খুবই দুঃখজনক। তাই বলতে হচ্ছে, শক্ত আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
বিএনপির পরবর্তী রাজপথমুখী কর্মসূচি কী হবে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, আমরা রাজপথেই আছি। আপনারা দেখছেন আমরা রোডমার্চ কর্মসূচিতে রয়েছি। হাজার হাজার মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করছে। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আমরা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছি। এ সরকারের পতনের আর বেশি দেরি নেই। শিগগিরই ধাপে ধাপে আমাদের আরও কঠিন কর্মসূচি আসবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করব। এখন কঠোর কর্মসূচির ডাক আসবে; আমাদের নেতাকর্মীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সরকারের পতন ঘটাব। এতে সরকার অবশ্যই পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন— সবকিছুই শেখ হাসিনা সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। আমাদের জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়া পরিবারকে বলে দিয়েছেন, তিনি শর্তে কোনো মুক্তি নেবেন না। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনেও যাবে না বিএনপি। আমরা জোর খাটিয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। তবে আমরা সরকারকে সেই চাপ দিতে পারি। আমরা গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করেই সরকারকে বাধ্য করব ক্ষমতা থেকে সরে যেতে। আমাদের তরুণরাসহ এ দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। তাদের চাওয়া অনুযায়ী আমাদের জনপ্রিয় নেত্রী অবশ্যই কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। আপনারা শিগগিরই তা দেখতে পাবেন কী কর্মসূচি আসছে।