নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের উত্তরাঞ্চলে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠছে তিস্তার পানি। প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে পানিসমতল। গত রাত ৮টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তার পানি। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তিস্তাপারের মানুষের মধ্যে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধার তিস্তাপারের বাসিন্দাদের নিরাপদ অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদীপারে রেড অ্যালার্ট জারি করে মাইকিং করছে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। উদ্ধার তৎপরতার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে প্রয়োজনীয় নৌকা ও আশ্রয় কেন্দ্র।
জানা গেছে, ভারতের উত্তর সিকিমে অতি ভারী বর্ষণে তিস্তা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে সেখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ড্যাম (বাঁধ) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানি বাড়ায় সিকিম থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চুংথাম এলাকা। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গাছপালা। কালিম্পংয়ে ভেসে গেছে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। সেনাছাউনি ভেসে গিয়ে ২৩ জওয়ানসহ অন্তত ৪৩ জন নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে। উজানে তিস্তার পানি বৃদ্ধি ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গেও তিস্তাপারে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ভারতের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের তথ্যানুযায়ী, উত্তর সিকিমে তিস্তার চুংথাম ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উজানে তিস্তার পানিসমতল দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিসমতল বাড়ছে। গতকাল বিকাল ৪টার তথ্যানুযায়ী ডালিয়া পয়েন্টে পানিসমতল বিপৎসীমার ৫ সেমি ওপরে অবস্থান করছিল। রাত ৮টায় ২৫ সেমি ছাড়িয়ে যায়। গতকাল রাতেই পানি বিপৎসীমার ৫০ সেমি ওপরে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। পাউবোর এই প্রকৌশলী বলেন, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা জেলার তিস্তাপারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল পাউবোর বন্যা পূর্বাভাসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার তিস্তা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে বন্যা পরিস্থিতির খবর
রংপুরের পাঁচ জেলায় সতর্কতা জারি : তিস্তার পানি হুহু করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তিস্তাবেষ্টিত রংপুরের পাঁচ জেলায় ভয়াবহ বন্যার সতর্কতা জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকালই নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করেন স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। অসময়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় নদীপারের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত দেশের উজানে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তার পানি ২৮৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়। এতে বাংলাদেশেও তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পাউবোর তথ্যানুযায়ী, তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল বিকাল ৩টায় বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছিল। রাত ৮টায় বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ভারতে ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ড্যামে প্রচুর পানি থাকে। ওই পানি প্রবেশ করলে উত্তরাঞ্চলের তিস্তাতীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হতে পারে। ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রমের সর্বোচ্চ রেকর্ড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কুড়িগ্রামে ৫৯ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত : কুড়িগ্রামে তিস্তাতীরবর্তী এলাকাগুলোয় বন্যার সতর্কতা জারি করে মাইকিং করছে স্থানীয় প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, বন্যার সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে জেলা, উপজেলা প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাঠে কাজ করছেন। উদ্ধার অভিযানের জন্য রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলায় বেশকিছু নৌকা ও ৫৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
লালমনিরহাটে নদীপারে রেড অ্যালার্ট : লালমনিরহাটে হুহু করে বাড়ছে তিস্তার পানি। ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তিস্তাপারের মানুষ। নদীপারে রেড অ্যালার্ট জারি করে মাইকিং করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্লাহ জানিয়েছেন, ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় তিস্তা অববাহিকায় সতর্কতা জারি করে মাইকিং করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চর ও নদীপারের লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানির উচ্চতা বেড়েছে ৭৯ সেন্টিমিটার। বন্যায় মৌসুমি ফসলসহ খেতখামারের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে টানা বর্ষণ শুরু হয় সিকিমে। তার ফলে উত্তর সিকিমের মঙ্গান জেলার লোনাক লেকে ফাটল দেখা দেয়। এর কারণেই তিস্তায় আচমকা পানির স্তর ১৫-২০ ফুট বেড়ে যায়। প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে ঘর, গাড়ি, গাছপালা। সিকিম থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চুংথাম এলাকা। কালিম্পংয়ে ভেসে গেছে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক সেনাছাউনি। সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, তাদের ২৩ জওয়ানের খোঁজ মিলছে না। পানিতে ভেসে যায় সেনাবাহিনীর একাধিক গাড়ি। এ ছাড়া একাধিক স্থানীয় নাগরিকও নিখোঁজ রয়েছেন। সব মিলিয়ে নিখোঁজের সংখ্যা ৪৩।