বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে মহাসংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানির লাগাম টেনেও রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। অর্থপাচার ঠেকাতে এলসি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। রেমিট্যান্স বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপসহ ব্যয় কমানোর চতুর্মুখী পদক্ষেপ নিয়েও রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করা যাচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বর মাসে যে পরিমাণ আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়েছে; তা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু আলোচিত মাসে রিজার্ভ কমে গেছে দুই বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা খরচের সবচেয়ে বড় খাতে সাশ্রয়ী হয়েও রিজার্ভের মজুত বাড়ানো যাচ্ছে না। অজানা খাতে বৈদেশেক মুদ্রা খরচ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ৩৫ মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) নিষ্পত্তি করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ মাসে নতুন করে এলসি খোলার পরিমাণও আগের মাস আগস্টের তুলনায় প্রায় ১৬ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এলসি সেটেলমেন্ট বা আমদানি পেমেন্ট সেপ্টেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২০ সালের অক্টোবরের পর থেকে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলো ৪.৬৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছে, যা আগস্টে ছিল ৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার। বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পেমেন্টের চাপ কমাতে গত এক বছর ধরে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা কমিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার একটি আভাস আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ দেখলেই পাওয়া যাবে। ডলারের সংকটের কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ভবিষ্যতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। ব্যাংকগুলোরও কিছু করার নেই কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এখন যে পেমেন্ট করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশ ছয় মাস আগে খোলা ডেফার্ড এলসি পেমেন্ট। সাইট এলসি এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এসব এলসি খোলার এক মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকের কাছে এখন আগে খোলা ডেফার্ড এলসির ম্যাচিউরিটি পোর্টফোলিও রয়েছে, যে অনুসারে তারা পেমেন্টের সময় নির্ধারণ করছে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ডলারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০০-৬০০ মিলিয়ন ডলার কম। তাই ব্যাংকগুলো সহজে এলসি খুলছে না। বর্তমানে যেসব এলসি খোলা হয়েছে তার ৯০ শতাংশই ডেফার্ড ছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২৬ দিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছিল ১৯১ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার। তার পরের এক সপ্তাহে আরও কমেছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে প্রায় এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০০ কোটি বা দুই বিলিয়ন ডলার।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে রিজার্ভের এই চিত্র দেখা যায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট রিজার্ভ ছিল দুই হাজার ৩০৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। গত বুধবার শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় দুই হাজার ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। তার মানে, ৩৪ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ২০১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল চার হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে দুই হাজার ৬৮৬ কোটি (২৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন) ডলার। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে দুই হাজার ১০৫ কোটি ডলার। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না।
আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি ডলার করে কমেছে। রাশিয়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। যদিও ওই অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ধরে রাখে। পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। যদিও ডলার-সংকট কাটেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে, অন্য কোনো খরচ নয়। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচকই হলো বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভ। অন্যদিকে আইএমএফের ঋণ নিয়েও দুশ্চিতা বেড়ছে। কারণ সংস্থাটির আরোপিত শর্ত পূরণ না হওয়ায় ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে। আর অন্য দাতাগোষ্ঠীও আইএমএফকে অনুসরণ করতে পারে। বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে রিজার্ভ বিপজ্জনক পরিস্থিতে পৌঁছে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশকে দেয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল গত জুনে প্রকৃত রিজার্ভ দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার, গত সেপ্টেম্বরে দুই হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে দুই হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। এ জন্য লিখিতভাবে বাংলাদেশকে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি জানিয়ে দেয় আইএমএফ। এই হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে জানানো শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদেরাও দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন।
গত বুধবার ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের (আইবিএফবি) বার্ষিক সম্মেলনে ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। এখন যে রিজার্ভ আছে, তা বিপজ্জনক পর্যায়ে না গেলেও উদ্বেগজনক পর্যায়ে। প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলার কমছে। এই অবস্থায় চললে একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন ডলারের দাম বাজারে ছেড়ে দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোনো উপায় থাকবে না।