নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক মাঠে বরফ গলছে না। সরকার ও বিরোধী পক্ষ এ ইস্যুতে দুই মেরুতে অবস্থান করছে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। তবে দ্বাদশ নির্বাচনের যেহেতু বেশি সময় বাকি নেই, সেহেতু এ বিষয়ে একটি সমাধানে আসতে হবে। এমনটি প্রত্যাশা সাধারণ মানুষ, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক ও প্রবীণ রাজনীতিকদের। নির্বাচন সুষ্ঠু করার অঙ্গীকার সরকারের রয়েছে, আবার বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও তাই চায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। বিএনপি বিশ্বাস করতে চায় না, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হবে, তাদের আশঙ্কা সরকার এখন বললেও অতীতের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে পারে।
অন্যদিকে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছে না। কারণ, অতীত ইতিহাস আওয়ামী লীগের জানা রয়েছে, জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর নতুন একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল, কিন্তু ওই সরকারের সময় জাতীয় পার্টিও বিপর্যয়ে পড়ে, সে কারণে সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজপথে রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সংঘর্ষ ও সঙ্ঘাত এড়াতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিরোধীয় উভয় পক্ষকে সংলাপে বসতে দীর্ঘদিন ধরে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এত দিন এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনমনীয় দেখা গেলেও এখন সুর কিছুটা নরম মনে হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে। তারা মনে করছেন, কিছুটা ছাড়া দিয়ে উভয় পক্ষ যেকোনো আলোচনা বসতে পারে এবং এটিই এখন জরুরি।
আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে গতকাল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলেও বুঝা গেছে, সংকট সমাধানে আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে অনেকটা নমনীয় ভাব দেখা গেছে। এ ছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও সংকট সমাধানে আলোচনার কথা বলেছেন। অন্যদিকে, গত ৯ অক্টোবর সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আলাদা বৈঠক করার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ওই ব্রিফিংয়ে বলা কথা থেকে একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান সাংবাদিক খালিদ মহিউদ্দিন। তিনিও মনে করেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপের বিষয়ে উভয় পক্ষকে নমনীয় দেখা যাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমরা আগেই বলে দিয়েছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাবো না, তার অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়’, তিনি জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেই আমরা আলোচনায় বসব। পদত্যাগের পর তো আর আলোচনায় বসার দরকার হয় না, সে কারণে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে তো এখনই আলোচনার তাগিদ দিচ্ছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা, সে ক্ষেত্রে আপনারা কী করবেন, এমন প্রশ্নে বিএনপির এই নেত্রী কোনো কথা বলতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, আমাদের কথাবার্তা ও অবস্থান পত্র-পত্রিকায় পাবেন। অর্থাৎ সংলাপের বিষয়টি তিনি একেবারেই নাকচ করে দেননি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিলেও তিনি এখনই সংলাপের দরকার নেই বলে মনে করেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অনেক কথা বলে, তারা সংলাপের কথাও বলেন, কিন্তু এখনই সংলাপের দরকার নেই। অর্থাৎ তিনি সংলাপের প্রয়োজনীয়তা একেবারে নাচক করে দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগর উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ে সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল খালেকও ‘সংলাপের প্রয়োজনীয় নাকচ করেননি। তিনি বলেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তো বলছেন, অতীতে সংলাপ করে তারা ভুল করেছেন। সে ক্ষেত্রে আমরা সংলাপের কথা বলে লাভ কি, আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সরকারের বিরোধী পক্ষ হচ্ছে বিএনপি, তারা আগে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে।
এদিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধান না হলে দেশ সঙ্ঘাতের মুখে পড়বে। এতে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে না, খারাপের দিকে যাবে।’
এদিকে সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈঠক থেকে আমার পাঠ হলো— খুব শিগগিরই হয়তো আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ বা আলোচনা দেখতে পাবো। এ সময়ের রাজনৈতিক বুলিতে পরিণত হওয়া ‘তলে তলে’ নয়, প্রকাশ্যেই। তার এমন মনে হওয়ার কিছুটা বিশ্লেষণও করেছেন তিনি। ডয়চে ভেলের বাংলা ভার্সনে তিনি উল্লেখ করেন, মার্কিনিদের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তারা বলেছে যে, কমেপ্রামাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি-না? তখন আমরা বলেছি, কমেপ্রামাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের স্পেস থাকতে হবে। সেই স্পেস বিএনপি রাখেনি। তারা সেই স্পেস ব্লক করে দিয়েছে। তারা (বিএনপি) প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়।’ বলা হচ্ছে, কমেপ্রামাইজের ক্ষেত্রে বিএনপি কোনো স্পেস রাখেনি, ব্লক করে রেখেছে। স্পেস কেউ ব্লক করে রাখলে তা আনব্লক করা যায়, আর যায় বলেই ব্লকের প্রসঙ্গ এলো বলেই মনে হয়।
এদিকে মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘এই সরকারের অধীনে যে আন্তর্জাতিক মানের সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না সে জন্যই তারা এই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছে। আমরা বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, তারা সেভাবে বলবে না। তারা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন।’ বিএনপি নেতার বক্তব্য পরিষ্কার, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে সাক্ষী রেখে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিদেশিদের কাছ থেকে, বিশেষ করে অ্যামেরিকানরা গ্যারান্টি দিলে তারা হয়তো নির্বাচনে আসবে। আর এ জন্য প্রয়োজনে কিছুটা ‘কমেপ্রামাইজ’ও করবেন তারা, সে হিসেবে আলোচনার সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন এ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।