বিচার ব্যবস্থায় নেই শাস্তির গাইডলাইন।

বিচার ব্যবস্থায় নেই শাস্তির গাইডলাইন।

দেশের বিচারাঙ্গনে শাস্তি প্রদানে নেই সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। বিচারকদের হাতে শাস্তি দেয়ার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন সংকটে শীর্ষ অপরাধী থেকে ছিঁচকে চোর— সবাই সহজেই লাভ করছে জামিনে মুক্তি। ফলে ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজিসহ সিরিয়াল কিলাররাও বেরিয়ে ফিরছে ভয়ঙ্কর রূপে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের ওপর সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনা এর প্রমাণ। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনাঙ্গন থেকে শুরু করে সব মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সম্প্রতি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের একাধিক ঘটনায় এমনটিই দেখা গেছে।

বিভিন্ন মামলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান সময়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আগের কিছু মামলার রেফারেন্স নিয়েই সম্পন্ন হচ্ছে অধিকাংশ জটিল ও বড় মামলার বিচারিক কার্যক্রম। অথচ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট গাইডলাইন থাকার দরকার ছিল বলে মনে করছেন দেশের আইনজ্ঞরা।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় সন্তানসহ দম্পতিকে হত্যা করে সাগর ও ঈশিতা নামে আরেক দম্পতি। এর আগে মাত্র ২০০ টাকার জন্য ২০২০ সালেও টাঙ্গাইলের মধুপুরে একই পরিবারের চারজনকে খুন করে ঘাতক সাগর। সে সময় র্যাব-১২ এর সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করেন। সাড়ে তিন বছর কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের জুনে জামিনে মুক্তি পায় সাগর। এর চার মাসের মাথায় ফের স্ত্রীকে সাথে নিয়ে খুনের ঘটনা ঘটায় সে।

সিরিয়াল কিলার ধর্ষক বা বড় ধরনের অপরাধী কিভাবে দ্রুত সময়ে জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় অপরাধ করে, এ বিষয়ে একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে আদালত জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে। জামিনযোগ্য অপরাধে উপযুক্ত জামিনদার হলে কোর্ট জামিন দিতে বাধ্য। জামিন অযোগ্য অপরাধে কোর্ট জামিন দিতে বাধ্য নন। ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা-৩৪৯ (গ) (১) ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বিচার সম্পন্ন করবে ১৮০ দিনে। ধারা-৩৪৯ (গ)(২) অতিরিক্ত দায়রা জজ বিচার সম্পন্ন করবেন ৩৬০ দিনে। ধারা-১৬৭ অনুযায়ী, ১২০ দিনে চার্জশিট আদালতে দিতে হবে। এগুলো বাস্তবে অনুশীলন হয় না বললেই চলে। তবে আইনে বলা আছে— বিচারকার্য চলতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ধারা-৪৯৭ জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন পাবে না। তবে শর্ত হলো— যদি আসামি ১৬ বছরের কম বয়সি, স্ত্রীলোক বা অক্ষম হয়, আদালত তাকে জামিনের নির্দেশ দিতে পারবেন।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ‘চাপাতি ফাহিম’ জেল থেকে জামিনে বের হওয়ার ১০ দিন পর ফের পুলিশ তাকে রিভলবারসহ গত ৬ অক্টোবর শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করে। সে দীর্ঘদিন ধরে মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছিল। চাঁদা না পেয়ে এক ব্যবসায়ীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে দোকান থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়। চাপাতি নিয়ে ঘুরে বলে তাকে সবাই ‘চাপাতি ফাহিম’ নামেই ডাকে। তার বিরুদ্ধে মিরপুর থানাসহ বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের পাঁচটি মামলা রয়েছে।

ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর স্পেশাল পিপি মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, যে আইন যখন তৈরি হয় রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই পজিটিভ-নেগেটিভ চিন্তার পরই একটি আইন তৈরি হয়। ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে এর পজিটিভ সাইট বেশি হবে। সর্বসম্মতিক্রমে মনে করা হয় নেগেটিভ সাইট কম পজিটিভ সাইট বেশি— সে কারণে আমি মনে করি, অবশ্যই এই আইনটি বাস্তবায়ন হলে মানুষ উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এস এম মইনুল করিম বলেন,‘ নতুন আইনের চেয়ে যে আইন আছে তার প্রয়োগ বেশি দরকার। যেমন রিমান্ডের ব্যাপারে হইকোর্টের সুস্পষ্ট অনেক গাইড আছে তা সঠিকভাবে মানা হয় না। ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ বা ‘সাজা প্রদান নীতিমালা’ দরকার হয় না, যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়। তবে অবশ্যই এই নীতিমালা ভালো; মনে হয় না এর যথাযথ প্রয়োগ হবে। যদি যথাযথ প্রয়োগ হয় তাহলে সবাই দ্রুত সময়ে সঠিক বিচার পাবে।

ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ বলেন, ‘জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন পাওয়ার মূল কারণ ধারা-৩৪৯ (গ) (২) অনুযায়ী, ৩৬০ দিনে বিচার শেষ হয় না। ধারা-১৬৭ অনুযায়ী, সংবাদ প্রাপ্তির তারিখ বা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে চার্জশিট বা তদন্ত শেষ হয় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট বা চার্জশিট না হওয়ায় অপরাধীরা জামিনের আবেদন করে। তারা আদালতকে বোঝায়, বিনা-চার্জশিটে, বিনা-বিচারে দীর্ঘ দুই বছর বা তারও বেশি সময় বন্দি। তখন এই আইনের কারণে আসামিকে জামিন দেয়া হয়। আসামি বের হয়ে অনেক সময় সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালত থেকে দূরে রাখে এবং তাদের সমস্যা সৃষ্টি করে। এ থেকে বের হতে হলে অবশ্যই দ্রুত বিচার করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত তদন্ত করে সাক্ষীকে কোর্টের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সিরিয়াল কিলার বড় ধরনের অপরাধীর এই মামলাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। দ্রুত বিচার না হওয়ায় ৩৬০ দিন পার হলে তাদের জামিন পাওয়ার চান্স থাকে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ বা ‘সাজা প্রদান নীতিমালা’ নেই; তবে উন্নত বিশ্বে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই শাস্তি দেয়ার এই নীতিমালা রয়েছে। তাই শাস্তি দেয়ার জন্য বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ নির্দেশিকা প্রয়োজন। অপরাধের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে এই নির্দেশিকা প্রণয়ন করা জরুরি।

সেনটেনসিং গাইডলাইনের রায় বর্তমানে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। যশোরের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনার (রাষ্ট্র বনাম মো. লাভলু) মামলায় বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে পূর্ণাঙ্গ রায়ে ‘সেনটেনসিং গাইডলাইন’ বা ‘সাজা প্রদান নীতিমালা’ উঠে এসেছে। গত ১৮ মে ওই রায় প্রকাশিত হয়। ৮৪ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ। ওই রায়ে বলা হয়েছে— ‘মামলায় যখন উভয় (বাদী-বিবাদী) পক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হবে, তখন অভিযুক্তকে দণ্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে উন্মুক্ত আদালতে সে অভিমত বিচারক কর্তৃক উভয়পক্ষের আইনজীবীদের জানাতে হবে। এরপর উপযুক্ত শাস্তি নির্ধারণের জন্য আসামির শাস্তির বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ ধার্য করবেন। সেই ধার্য তারিখের শুনানি শেষে আসামির সামাজিক অবস্থান, অপরাধের ধরন অর্থাৎ অভিযুক্ত অভ্যাসগত, পেশাদার অপরাধী কি-না, নাকি আকস্মিক অপরাধী ইত্যাদি, বয়স ও আর্থিক অবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে আসামিকে উপযুক্ত বা আনুপাতিক সাজা আরোপ করতে পারবেন। সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারকের মূল্যায়ন কী হবে, তা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে— ‘সে শুনানির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সাজা আরোপের ক্ষেত্রে বিচারককেও অপরাধীর এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। সেই সাথে অভিযুক্তের ওপর শাস্তি আরোপের প্রভাব, বিলম্ব বিচারে অভিযুক্তের মানসিক পীড়ন এমনকি অপরাধীর সংশোধনের বিষয়টিও ভাবতে হবে। এরপরই কেবল বিচারক অভিযুক্তের সাজার রায় ঘোষণা করতে পারবেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট নাজমুল আহসান দ্বীপ আমার বলেন, ‘আমাদের সমাজে দুই ধরনের ক্রাইম হয়— হোয়াইট কালার ও ব্লু-কালার। ব্লু-কালার ছোট অপরাধ— চুরি ছিনতাই মাদক সেবন ইত্যাদি। অন্যদিকে হোয়াইট কালার (ভদ্রবেশী) অপরাধ— সমাজে প্রভাব বিস্তার করার জন্য কাউকে খুন করা, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কারো ওপর জুলুম, সম্পত্তি লুণ্ঠন করা ইত্যাদি। এ অপরাধগুলো করার পরে তারা গ্রেপ্তার হয় ঠিকই কিন্তু জেলের মধ্যে বেশি দিন থাকে না। তারা ক্ষমতাশালী অপশক্তির সহযোগিতায় জামিনে অল্প সময়ে বেরিয়ে আসে এবং পুনরায় অপরাধ করে। সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করার লক্ষ্যে সংবিধানের আর্টিকাল-৭৭-এর ন্যায়পালের একটি বিষয় আছে। এই (৭৭) ন্যায়পাল যদি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে যেকোনো ধরনের মাফিয়া চক্র সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে জামিনযোগ্য আপরাধের জামিন দেয়া আদালত বাধ্য। মূলত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার বিধান মতে, জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন দেয়া হয়। এই ধারায় বিশেষ করে যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়, তাহলে আদালত তাকে জামিন দিতে পারেন, যদি সে ১৬ বছরের কম বয়সি হয়। অভিযুক্ত যদি মহিলা হয়, অথবা অসুস্থ ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন আদালত। এর বাইরে আদালত জামিন দিতে বাধ্য নন। তবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যখন একজন বড় অপরাধী আটক হয়; তখন তাকে জামিন করানোর জন্য সর্বোচ্চ উপর লেভেল থেকে সুপারিশ করা হয়। এ কারণে আসামিকে বেশি দিন জেলে থাকতে হয় না। দ্রুত সে জামিন লাভ করে তা হতে পারে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জজকোর্ট, হাইকোর্ট থেকে। অপরাধী সমাজে পুনরায় আপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ