দৃশ্যমান সিন্ডিকেট, অদৃশ্য রাজনীতি

দৃশ্যমান সিন্ডিকেট, অদৃশ্য রাজনীতি

পণ্যের মূল্য নিয়ে কেউ যাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মনোপলি অবস্থার সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। কিন্তু আইন করেও ঠেকানো যায়নি বাজার সিন্ডিকেট। দেশে কিছু দিন পর পরই সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, কাঁচা মরিচ, ডিম, স্যালাইনসহ কোনো না কোনো পণ্য।

ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দামে বিক্রি করায় ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে রাঘব বোয়ালরা। অভিযোগ রয়েছে উঁচু পর্যায়ের সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না বা নেওয়া হচ্ছে না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে সিন্ডিকেটের বিষয়টি বার বার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও ক্রেতাকে সুরক্ষা দিতে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। সর্বশেষ শুক্রবার

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, বাজারের সিন্ডিকেট যদি দেখতে পারতাম, ধরতে পারতাম, তা হলে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।

তিনি বলেন, সিন্ডিকেট ধরা যায় না, অধরা থেকে যায়। তবে তা সাময়িকভাবে বাজারের ভেতরেই থাকতে পারে। সিন্ডিকেট হয়, সিন্ডিকেট ভাঙে, আবার নতুন সিন্ডিকেট হয়।

তবে সিন্ডিকেটে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে মনে করে ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন সময়ের আলোকে বলেন, আসল তথ্য আড়াল করতেই পরিকল্পনা মন্ত্রী সিন্ডিকেট নিয়ে এমন কথা বলেছেন। কারণ সিন্ডিকেটে কারা রয়েছে তার সব তথ্যই গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারের কাছে রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় সরকার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। তাদের কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়নি, শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এই গাফিলতির কারণে বর্তমানে সিন্ডিকেটের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাদের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। তিনি বলেন, আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য ক্যাবের পক্ষ থেকে বার বার দাবি জানানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের বাজার যে অস্থির এটা সরকার দীর্ঘ দিন স্বীকারই করেনি। যদি যথাসময়ে পদক্ষেপ নিত তা হলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো।

তিনি বলেন, সরকারের ১১টি সংস্থা বাজার তদারকির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে বাজারে পাওয়া যায় না।

ক্যাবের সহ-সভাপতি বলেন, মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে প্রভাব বিস্তার করছে ব্যবসায়ীরা। তাই বাজার ব্যবস্থাপনার যেকোনো সিদ্ধান্তে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধান্য পাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে একাধিকবার বিরোধী দলের সদস্যদের কঠোর সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখেও পড়েন। জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রী বলেছিলেন, চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এটা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে।

তবে পরবর্তী সময়ে তিনি আবার বলেছিলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট আছে এমন কথা তিনি বলেননি।

বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং প্রতিযোগিতা কমিশন। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠ পর্যায়ে খুচরা ও পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করলেও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তেমন একটা নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রমও খুবই সীমিত বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তাদের মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

তবে শুধু কয়েকটি বাজারে নজরদারি ও জেল জরিমানা করে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামানো অসম্ভব বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

তার মতে, ব্যবসায়ীদের অসাধু তৎপরতা থেকে স্থায়ীভাবে বের করে আনতে না পারলে শুধু জেল-জরিমানা করে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে বিপণন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় বিপণন ব্যবস্থার ভেতরে যে অনিয়ম ও অস্থিরতা চলছে সেটি সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করা না গেলে, শুধু অভিযানে কাজ হবে না।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপের মধ্যে অধিক মুনাফা লাভের প্রবণতা আছে। ব্যবসায়ীদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তার মতে, বাজার স্বাভাবিক রাখতে এই বিশাল বাজারের সঙ্গে যে অংশীজন জড়িত, যেমন কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার-সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন কোনো দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে গেলে দামও আস্তে আস্তে বেড়ে যায়। তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অলিখিত সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত বলে তিনি মনে করেন না। আবার কোনো পণ্যের সরবরাহ কম থাকলেও ওই সেক্টরের সমিতির মাধ্যমে অদৃশ্য সিন্ডিকেট হয় এবং দাম বেড়ে যায়।

এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো জিনিসের চাহিদা কখন বেড়ে যায় বা সংকট তৈরি হতে পারে তা আগে থেকেই মোটামুটি বোঝা যায়। তাই ওই সময়ে ওই পণ্য প্রয়োজনে আমদানির ব্যবস্থা করলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তার মতে, সমস্যার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংকট তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যাওয়ার পর দাম নির্ধারণ করে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ তখন ওই সময়ে দাম নির্ধারণ করতে চাইলে একটি গ্রুপ সরকারের সঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে সুবিধামতো দাম নির্ধারণ করে। তাই সরকারের উচিত সিন্ডিকেট ঠেকাতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

অন্যদিকে বাজারের যেকোনো সিন্ডিকেট ও অপতৎপরতা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেছেন, যেকোনো সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা ডিএমপির রয়েছে।

বৃহস্পতিবার ডিএমপি সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিশেষ সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের যে মনিটরিং কমিটি যারা আছে, তাদের সঙ্গে পুলিশও থাকবে। প্রয়োজনে বড় বড় বাজারে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আমাদের পুলিশও অংশ গ্রহণ করবে। সিন্ডিকেটের পেছনে রাজনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে কি না এবং তা ভাঙা সম্ভব কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক অপতৎপরতা কারও আছে তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তারা কাজ করছে। যদি এ ধরনের কোনো কিছু তাদের কাছে আসে তা হলে যেকোনো সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার মতো সক্ষমতা ডিএমপির রয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান গত সোমবার ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সিন্ডিকেটেরও এখন রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। যে কারণে তাদের ধরা যাচ্ছে না।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাকও বলেছেন, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেঁধে দিলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ