দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা পাল্টে যেতে পারে, এমন সম্ভবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে সে প্রশ্নে দুই মেরুতে অবস্থা করছে। এ ইস্যুতে উভয়পক্ষ কঠোর অবস্থানে থাকলেও এখন সুর কিছুটা নরম। এই নরম সুরের নেপথ্যে আন্তর্জাতিক শক্তির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নিতে আসা মার্কিন প্রতিনিধি দল দেশের রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দল, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ওইসব বৈঠকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা নেয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে চলমান সংকট নিরসনে অর্থবহ সংলাপের তাগিদও দেয় মার্কিন প্রতিনিধি দলটি। সফরকারী দলটি সংলাপসহ পাঁচ সুপারিশও করে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই এবং এনডিআইয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এ মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের করা সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রকৃত অর্থে অর্থবহ সংলাপ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি, তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংলাপের ব্যাপারে বরফ গলতে পারে বলে একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এটা স্পষ্ট হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্যে। তিনি শর্তহীন সংলাপের কথা সামনে নিয়ে এসেছেন। বলেছেন, শর্তহীন সংলাপ হলে তার দল রাজি হতে পারে। কয়েকদিন আগেও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করতে কোনো ধরনের আগ্রহ দেখায়নি। দলটির সিনিয়র নেতারা প্রকাশ্যে বক্তৃতাকালেও সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আবদুল খালেকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপকালে সংলাপ নিয়ে এখনই কোনো কথা বলতে রাজি হননি। প্রায় একই সময়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনিও সংলাপ নিয়ে তেমন কোনো সম্ভাবনার কথা বলেননি। কিন্তু এখন শর্তহীন সংলাপে আওয়ামী লীগ রাজি হতে পারে বলে দলটির সাধারণ সম্পাদক জানানোর ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, উভয়পক্ষকেই ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যেতে হবে।
সম্প্রতি সফর করে যাওয়া মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে চলা বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে দলটির যে অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন তাতেও কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখছেন বিশ্লেষকরা। ওইদিন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলীয় সরকারের অধীনে ভোট চাই না এমন কথা না বলে তিনি বলেছেন শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে উল্লেখ করেন। তার ওই বক্তব্যে নমনীয়তা দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএনপির এই নেতার কথায় বুঝা যাচ্ছে তারা শেখ হাসিনার অধীনে ভোটে না গেলেও আওয়ামী লীগের অধীনে ভোটে যেতে পারে। অর্থাৎ নির্বাচন ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও শীতল হাওয়া বইছে। আর কয়েকদিন পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের আগে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা বেশ তৎপর রয়েছেন। বিশেষ করে বেশি তৎপরতা চালাচ্ছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। দেশটি বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় সেটি নিশ্চিত করতে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা একে বহুমুখী তৎপরতা বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশে বর্তমান নির্বাচন পরিস্থিতি কেমন, সবার জন্য নির্বাচনি মাঠ সমতল রয়েছে কি-না, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা নিরপেক্ষ, নির্বাচনের প্রচারণাকাল ও নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি কেমন হতে পারে এসব বিষয়ে এসেসমেন্ট করার জন্য এক সপ্তাহ ঢাকায় থেকে গেলেন একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল। প্রি-ইলেকশন এসেসমেন্ট করতে দলটি ঢাকায় এসেছে গত ৭ অক্টোবর। সাত সদস্যের এই দলটি ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটান। এদিকে গতকাল থেকে তিন দিনের জন্য ঢাকা সফরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার। তিনি ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবেন। আফরিন আখতার তার সফরে একাধিক এজেন্ডা রাখলেও মূল এজেন্ডা থাকছে বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তার দেশের অবস্থান ও ইচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করা।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি তৎপরতা নতুন কিছু নয়। আগের নির্বাচনগুলোতেও বিদেশি কূটনীতিকরা তৎপর ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেনো বিদেশিরা মাথা খাটান সাধারণ নাগরিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশিরা নিজেদের স্বার্থেই তৎপরতা চালান। বিশেষ করে যে দেশের বিনিয়োগ যত বেশি সে দেশ তত বেশি তৎপরতা চালিয়ে থাকেন। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হলেও তৎপরতায় পিছিয়ে থাকে না কোনো কোনো দেশ। সেটি অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক কারণে। এ অঞ্চলে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেও কোনো কোনো দেশ তৎপরতা চালায়। উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বিনিয়োগ যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে সে কারণে নির্বাচন এলে বিদেশিরা বেশি তৎপর হন।
বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নিতে আসা সাত সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল ১৫ অক্টোবর পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে। এগোলো হচ্ছে— এক. সহনশীল বক্তৃতা ও নির্বাচনি মুখ্য ইস্যুতে খোলামেলা-অর্থবহ সংলাপে বসা। দুই. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয়। তিন. সহিংসতার বিরুদ্ধে অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। চার. স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করাসহ সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং পাঁচ. নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনি অংশগ্রহণের সংস্কৃতি প্রচার। এছাড়া নির্বাচনে দেশটির অবস্থান কি হওয়া উচিত তা নিয়ে দেশের কর্তাদের পরামর্শ দেবেন। ঢাকা সফর করে যাওয়া ওই মার্কিন প্রতিনিধি দলের পরামর্শের আলোকেই দেশটি নির্বাচনকালে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা তা নির্ধারণ করবে।
এছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপর রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছেন। দেশটি বলছে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলগুলোকে আওয়ামী লীগ ও সংবিধাদের ওপর আস্থা রাখতে বলছে। আর বিএনপিসহ রাজপথে থাকা বিরোধী দলগুলো সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার চায়। এ পরিস্থিতিতে অর্থবহ সংলাপের কোনো বিকল্প দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এখন পরিস্থিতি খুবই জটিল। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাইলে দ্রুত সংলাপে বসতে হবে, অন্যথায় পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যেতে পারে।