অনলাইন ডেস্ক
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও দেশে সর্বজনস্বীকৃত একটি নির্বাচন ব্যবস্থা নেই। আর এ কারণেই প্রতিবার জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে আস্থা অনাস্থার দোলাচলে পড়ে রাজনীতি। বিষয়টি এখন আর দেশের গন্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বেও।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অগ্রাধিকার বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কথা জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর শেষে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পাঁচটি সুপারিশ করেছে। আর এ সমস্ত সুপারিশের প্রথম সুপারিশে তারা নির্বাচনী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। নির্বাচন ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনা এবং সংলাপের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, কোন শর্তযুক্ত সংলাপে যাবে না আওয়ামী লীগ। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকবলেছেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। তাঁর মতে, সংবিধান ও আইন মেনে যদি কেউ নির্বাচনে আসে, তাহলে আলোচনারও প্রয়োজন থাকে না। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শর্ত ছাড়া তারা কোন সংলাপে যাবে না। এ ধরনের নির্বাচন তারা করতেও দেবে না। নির্বাচন নিয়ে সংলাপের ব্যাপারে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এমন অনড় অবস্থানে সংলাপের কোন লক্ষণ দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৪ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদর দপ্তর বেলজিয়ামের ব্রাসেলস সফরে যাবেন। এই সফর থেকে ফিরে এসেই তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছু উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আর এর মধ্যে অন্যতম হলো আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সংলাপের আহবান জানাতে পারেন সকল বিরোধী দলগুলোকে। বিএনপি সেই সংলাপের আহবানে আসুক কিংবা না আসুক অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যেন সংলাপে আসে সেটি নিশ্চিত করা হবে। তবে কোন দিন কিভাবে তিনি সংলাপের আহবান জানাবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রগুলো বলছেন, ব্রাসেলস সফরের পরপরই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারেন। এই ভাষণে তিনি গণতন্ত্র সুরক্ষা এবং সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে আহবান জানাবেন এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য কারও যদি কোনো পরামর্শ থাকে তা গ্রহণ করা হবে বলেও জানাবেন। একই সাথে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে আলা আলোচনার জন্য আহবান জানাতে পারেন বলে জানা গেছে।
আবার আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলেছেন, চলতি মাসের শেষ দিকে জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এই অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী এরকম আহবান জানাতে পারেন। তবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ কিংবা সংসদে বক্তৃতা যেখানেই দিন না কেন প্রধানমন্ত্রী সকল রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আসার আহবান জানিয়ে একটি সংলাপের প্রস্তাব করবেন। আর এই যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করতে চায় তাদেরকে ডাকা হবে। কিন্তু বিএনপি এখন যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে বিএনপি সংলাপে সাড়া দেবে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এক ধরনের সংশয় রয়েছে। কারণ বিএনপি বলছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু ছাড়া সংলাপ করবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন মৃত ইস্যু। সংবিধানের বাইরে তারা কোনো কিছু করবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের আহবান জানাবেন এটি মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু বিএনপি সেই সংলাপের আহবানে সাড়া দেবে কিনা সেটি তারা একান্ত দলীয় বিষয় বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।
মূলত আওয়ামী লীগের কৌশল হলো সংলাপের ডাক দিয়ে তারা বল বিএনপির কোর্টে দিতে চায়। এরপর বিএনপি কি করবে সেটি তাদের দলীয় সিন্ধান্ত। বিএনপি যদি সংলাপে সাড়া না দেয় তাহলে আওয়ামী লীগ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংলাপ করবে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। আর বিএনপি যদি সে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করে তাহলে বিএনপিই বিপদে পড়বে এবং মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় আসবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল। কারণ মার্কিন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন ব্যক্তিদেরকে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনীয় সংলাপ নিয়ে কৌশলের খেলায় কে জয়ী হয়।
এদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপে বসার বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্ততপক্ষে দুটি বিষয়ে সরকার নমনীয় হলে সংলাপ বা আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাবেন তারা। এ দুটি বিষয় হচ্ছে ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ ও ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নেতাকর্মীদের মুক্তি’।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার অনুমতি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সেই আলোচনা শুরু হতে পারে বলে মনে করেন তারা। সম্প্রতি বিদেশি দেশগুলোর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির নেতারা এ মনোভাব পোষণ করেছেন। তবে যেহেতু ২০১৪ ও ’১৮ সালের সংলাপ নিয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ‘সতর্ক’ভাবে পা ফেলতে চাইছে দলটি। কেননা, তারা এবার সরকারের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হতে চায় না।
তবে পরিস্থিতি যাই হোক, এসব জটিল অবস্থা থেকে উত্তরণে বরাবরই আলোচনার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে গেছে রাজনীতি। এবার আলোচনায় শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনদের সম্মতি না থাকলেও সম্প্রতি তাদের শিবিরেই বইছে সংলাপের সুবাতাস।
কোনো চাপে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংলাপের কথা বলছে কি না এমন প্রশ্নে দলটির শীর্ষ নেতা এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, রাজনীতির খেলা ঘুরে গেছে, তাই আলোচনায় জোর দিচ্ছে বিরোধী পক্ষই।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলছেন, বিদেশিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে আন্দোলনের পালে হাওয়া না পেয়ে বিএনপিই এখন নির্বাচনে আসার রাস্তা খুঁজছে।
তিনি আরও বলেন, তারা যেভাবেই চায় আলোচনায় আসুক। আমরা সংবিধান অনুযায়ী আলোচনা করবো। তারা নির্বাচনে অংশ নিক সেটাই আমরা চাই। এ দুই নেতাই বিশ্বাস করেন, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণেই হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি এক নেতা বলেন, পর্দার সামনে বা পেছনে যাই হোক, প্রস্তাব পেলে তারা সংলাপের বিষয়টি ভেবে দেখবেন। সেই প্রস্তাবে দুটি বিষয়ের ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য থাকতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তাদের (আওয়ামী লীগ নেতাদের) সুর নরম হচ্ছে। আরও নরম হবে। তারা ডাকলেই যে আমরা সংলাপে যাব, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এজেন্ডার বাইরে সংলাপে নেই বিএনপি।