দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনীতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ জমেছে। এখনো শর্ত আর হুংকারে অনড় অবস্থানে বড় দুই দল। বিশ্বমোড়লরা দেখাচ্ছেন অগ্নিদৃশ্যে শীতল পথ। পর্দার আড়ালের স্নায়ুবাতাস ঘর থেকে জনসম্মুখে। বন্ধু দেশগুলো জানিয়েছে, তাদের সম্পর্ক এ দেশের জনগণের সঙ্গে; কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সঙ্গে নয়। অন্যরা ফাইনাল পর্বে টেস্ট হাওয়া দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে দেশে যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, গত দুদিন ধরে তার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলছেন, বিএনপির হাজার হাজার নেতা ঢাকা শহরের ঘরবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টে অবস্থান নিয়েছেন। কিছুই এখন ফাঁকা নেই! তারা আল্টিমেটাম দেবে, সাংবিধানিক কর্মসূচিগুলোতে ঘেরাও অবস্থানে যাবে। যে কোনোভাবে সরকারকে সরিয়ে দিতে রাজধানীতে জমায়েত হচ্ছে তারা। সরকারকে সরাতে গণবিপ্লবের চিন্তায়ও রয়েছে বিএনপি।
অন্যদিকে বিএনপিও নানাভাবে বিভিন্ন পাড়ায় শেষবেলায় অবস্থা বুঝে চূড়ান্ত মুভমেন্টের বার্তা দিচ্ছে। যে কর্মসূচির চিন্তায় তারা ছিল, তা আগেই ক্ষমতাসীন দলের সেকেন্ড পার্সন প্রকাশ করে দিয়েছেন! এখন বিএনপি পরিস্থিতি বুঝেই আজ জনসমাবেশ থেকে স্বল্পসময়ের জন্য বার্তা দেবে। তবে এবার অতীতের মতো সংলাপে সমাধানের পথ খুলছে না বলে অনেকটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শর্তে শর্তে গরম হাওয়া তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং সংসদ ভেঙে দেয়া ছাড়া তারা সংলাপে বসবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কোনো শর্তের টেবিলে বসবে না। তাই সকাল-বিকাল বিভিন্নরূপের রাজনৈতিক হাওয়া এবার রাজনীতির ভাগ্যাকাশে ভিন্ন কিছু ঘটার আভাস দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শর্তের বাধায় সংলাপ যে হচ্ছে না— এর অনেক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল, মার্কিন উপসহকারী মন্ত্রী আফরিন আখতারসহ বেশ কিছু এজেন্সি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে। সবাই জবাব ছেয়েছে নির্বাচন কীভাবে হবে। শুনেছেন বিদেশিরা। প্রাথমিক ধাপের বিষয়গুলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্যে বলে গেছেন। চলতি মাসের শেষ থেকেই তার ফলাফল দেখা যাবে হয়তো। তাতেও কিছু না হলে ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো চলতে থাকবে। সম্প্রতি কূটনৈতিক বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ত থাকা দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, এবার রাজনীতিতে অনেক আবহাওয়া যুক্ত হবে। অতীতের মতো যথাসময়ে নির্বাচন নাও হতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরোনো নীতিতে নির্বাচন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি বুঝতে পেরে আগেই ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যার ফলে অনেক পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। মার্কিন উপসহকারী মন্ত্রী আফরিন আখতার এখন ঢাকায় রয়েছেন। তিনি ঢাকা ত্যাগ করলে সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে কারা ভিসানীতির মধ্যে পড়েছেন, সেটি প্রকাশ হতে পারে। এটি স্পষ্ট যে, এবার আওয়ামী লীগ অতীতের চেয়ে কিছুটা চাপে রয়েছে।
এই দুই সিনিয়র রাজনীতিবিদের ভাষ্য, সরকারবিরোধীরা চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে কিছু সময় সংস্কার; তারপর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে। সেখানে আওয়ামী লীগের কাউকেও যুক্ত করতে চাচ্ছে না তারা। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ পন্থায় যেতে কোনোভাবেই রাজি নয়। তারা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব পথ অনুসরণ করেই এগিয়ে যেতে চাইছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকেও তারা শ্রদ্ধা জানাবে। সে ক্ষেত্রে যথাসময়ে নির্বাচন হওয়া-না হওয়া, অর্থাৎ পিছিয়ে যাওয়া কিংবা অনেক কিছু দৃশ্যপটের জন্ম হতেও পারে। শেষবেলায় রাজনীতিতে এরশাদের বিদায়ের পুনরাবৃত্তির মতোও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে পর্দার আড়ালের আবহাওয়ার সঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিএনপির ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। কর্মসূচিতে হাজার হাজার নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করছেন। সারা দেশেই নেতাকর্মীরা এখন প্রায় উজ্জীবিত। এমন পরিস্থিতিতেও বিএনপি কেন একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো ঐক্যেফ্রন্ট স্টাইলে নীতি গ্রহণ করে জোট গঠন করেছে। অথচ অধিকাংশ জোটনেতার কেন্দ্রীয় কমিটি নেই; জেলা-উপজেলায়ও কমিটি নেই। নামকাওয়াস্তে জোট গঠন নিয়ে ফায়দা কি? এ জোট গঠনের পেছনে কূটনৈতিক প্রেসক্রিপশন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জোটের শীর্ষ নেতাদের আদর্শের সঙ্গে কূটনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। এ জোটকে অনেকে ঐক্যফ্রন্টের ফটোকপিও বলছেন। বিএনপি যদি তার দলের মূল অবস্থান ও জনগণের ভাবনাকে জোটের কাছে ছোট করে দেয়, তাহলে বিএনপির জন্য দুঃসময় অপেক্ষা করছে বলেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যদিও বিএনপির হাইকমান্ড বলছেন, তারা রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে মাঠে নামবেন। তাই যে কোনো পরিস্থিতির জন্যই তারা প্রস্তুত।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, এটা দেশ-বিদেশের সবাই গভীরভাবে নজরে রেখেছে। এ পরিস্থিতির জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। পরস্পরের স্বার্থের জন্য কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সবাই শুধু শর্তের কথা বলে বিষয়টি কঠিনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবারও ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে বিরোধীরা সরকারের সে চেষ্টাকে বানচাল করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, মাঠে রয়েছে। গণতন্ত্র যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন এ ধরনের অবস্থা তৈরি হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতির আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আলাপ-আলোচনা ছাড়া কোনো সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। সুতরাং আলোচনা না হলে তো সংকট রয়েই যাবে। বিষয়গুলো দিন দিন আরও অন্ধকারের দিকে যাবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা এখন বিশ্বও বলছে। দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংকট তৈরি হয়েছে। এটি সমাধানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি।