নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। নির্বাচন কমিশনও মনে করছে, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য প্রত্যাশিত ‘অনুকূল পরিবেশ’ এখনো হয়নি। এ রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে ইসি। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর কখন কোন কাজ করা হবে, তার রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। লম্বা সময় রেখে তফসিল দেওয়া হবে, নাকি ৪০-৪৫ দিন সময় দিয়ে তফসিল দেওয়া হবে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন নির্বাচন কমিশনাররা।
যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে পরিবেশ কেমন হবে; ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে পরিস্থিতি হয়েছিল, সে রকম কিছু হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সে ধরনের কিছু হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান
একাধিক নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে তাঁরা মনে করছেন বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। প্রধান দুই দলের একটি নির্বাচনে না এলে সেই ভোট কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, না হবে; সেটা ইসি আর ভাবছে না। তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে মোটামুটি একটি ‘সুষ্ঠু’ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চায়। সে জন্য ভোটকেন্দ্রে চোখে পড়ার মতো ভোটার উপস্থিতি দরকার। তারা আশা করে, এই ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো ভূমিকা রাখবে। এর বাইরে একটা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন এবং প্রতিহত করার আন্দোলনে গেলে সহিংস পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এমন আশঙ্কার বিষয়টিও ইসির বিবেচনায় আছে। সে জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হবে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। সে সময় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের বেশ কিছু কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। বিএনপি নির্বাচনে না এলে এবারও সে রকম পরিস্থিতি হতে পারে—এই আশঙ্কার কথা সম্প্রতি এক বৈঠকে কমিশনকে জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। ১২ অক্টোবর ইসি তাদের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে ভোটের পরের ১৫ দিন পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রাখার পরিকল্পনা আছে ইসির।
ইসি সূত্র বলছে, পরিবেশ যা-ই হোক নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে তারা এখনো অটল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালও ইতিমধ্যে বলেছেন, কে নির্বাচনে এল, কে এল না; সেটা বিষয় নয়। নির্বাচনের লেজিটিমিসি (ন্যায্যতা) নিয়ে ইসি মাথা ঘামাবে না, তারা নির্বাচনের লিগ্যালিটির (আইনি বৈধতা) দিকটি দেখবে। তাঁর মতে, ভোটাররা যদি আসেন এবং ভোট দিতে পারেন, সেটিই হবে বড় সফলতা।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে পরিবেশ কেমন হবে; ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যে পরিস্থিতি হয়েছিল, সে রকম কিছু হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সে ধরনের কিছু হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তাঁরা আশা করেন, হয়তো রাজনৈতিক সমঝোতা হবে। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলেও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসি মনে করছে, বৈশ্বিক চাপ বিশেষত সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসিকে কিছুটা সুবিধা দেবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও কূটনৈতিক চাপের কারণে তারা ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন প্রতিহত করতে সহিংস কর্মসূচির দিকে যাবে না। আবার ক্ষমতাসীন দলও সতর্ক থাকবে। পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও একধরনের চাপে থাকবেন।
নির্বাচন কমিশন একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। তাতে মনে হয় নির্বাচন নিয়ে তারা সংশয়ে আছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন
তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ‘যেভাবেই হোক’ জয়ী হওয়ার মানসিকতা নিয়ে ইসির কিছুটা দুশ্চিন্তা আছে। ২০১৮ সালের মতো ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ যাতে না ওঠে, সে জন্য ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর চিন্তা করছে ইসি। ইতিমধ্যে ইসির একটি প্রশিক্ষণে পুলিশ ও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা ইসির এই চিন্তার সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছেন। তাঁরা চান ভোটের আগের দিন ব্যালট পেপার কেন্দ্রে পাঠানো হোক। তবে নির্বাচন কমিশনারদের কেউ কেউ মনে করেন, দুর্গম এলাকা বাদে অন্য সব এলাকার ভোটকেন্দ্রে ভোটের দিন সকালেই ব্যালট পেপার পাঠানো উচিত। কারণ, আগের দিন ব্যালট পেপার পাঠানো হলে কারচুপির অভিযোগ উঠতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে হয়। চলতি একাদশ জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, আগামী ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
ভোটের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছালেও নির্বাচন কমিশনের নিজেদের উপলব্ধি হচ্ছে, এখনো নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রত্যাশা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কর্মশালা করছে ইসি। এর অংশ হিসেবে ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকদের নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে সম্পাদকদের আলোচনার জন্য একটি ধারণাপত্রও দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। প্রত্যাশিত সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানতম দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। রাজপথে মিছিল, জনসমাবেশ ও শক্তি প্রদর্শন করে নিজ নিজ পক্ষে সমর্থন প্রদর্শনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত মীমাংসা বা সংকট নিরসন হচ্ছে বলে কমিশন মনে করে না। বিষয়টি রাজনৈতিক। নির্বাচন কমিশনের এ ক্ষেত্রে করণীয় কিছু নেই। নির্বাচন বিষয়ে দেশে পর্যাপ্ত আইন আছে। তবে আইন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমান্তরাল মিথস্ক্রিয়া না হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে আইনের বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হয় না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। তাতে মনে হয় নির্বাচন নিয়ে তারা সংশয়ে আছে। তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে শুধু ভোটারদের অংশগ্রহণ নয়, এটি দলীয় নির্বাচন। বিএনপি অন্যতম বড় দল। দলটির ৩০-৪০ শতাংশ সমর্থন আছে বলে ধরা হয়। তাদের সমর্থকেরা ভোট দিতে না এলে কত শতাংশ ভোট পড়বে? আইনি দিক থেকে ১ শতাংশ ভোট পড়লেও তা সঠিক। কিন্তু নৈতিকতার বিষয়টি দেখতে হবে। ২০১৪ সালে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হন। আইনি দিক থেকে এটি বৈধ, তা ঠিক আছে। কিন্তু আসলে সেটা কি যথাযথ নির্বাচন?