নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল আ.লীগে বাড়ছে বিবাদ

নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল আ.লীগে বাড়ছে বিবাদ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বিবাদ বাড়ছে। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেষারেষি ও ক্ষোভ। অনেক ক্ষেত্রেই তা মারামারি, বাড়িঘর ভাঙচুর ও খুনখারাবি পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এর ফলে অনেক শাখায় আটকে আছে কমিটি গঠনের কাজও। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ করতে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়াছেন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো নেতা কিংবা তার অনুসারীরা। এর মধ্যে শরীয়তপুর ও নেত্রকোনায় পঞ্চাশের অধিক নেতাকর্মীকে লাইভ অনুষ্ঠান করে দল ত্যাগ করতেও দেখা গেছে। কাউকে কাউকে ফাঁসানো হচ্ছে মামলার জালেও।

নির্বাচন সামনে রেখে দেশি-বিদেশি ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলায় দলীয় হাইকমান্ডকে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্ষোভ, দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ত্যাগী নেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করছে। তাদের ভাষ্য, দলের এমন অবস্থা চলতে থাকলে বিরোধী পক্ষ সহজেই আঘাত করার সুযোগ পাবে। তবে এটিকে দ্বন্দ্ব হিসেবে না ভেবে প্রতিযোগিতা বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন ‘নৌকা যার আমরা তার’ এই স্লোগানে সবাইকে কাজ করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার ভাষ্য, নির্বাচন এলে অনেকেই মনোয়ন চান। এই মনোনয়ন ঘিরে মতবিরোধ হয়। তবে দল মনোনয়ন ঘোষণা করে দিলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে।

তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন স্থানীয় নেতারা। ঢাকা বিভাগের একজন নেতা  বলেন, এবারের দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অনেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগের কমিটিতে কঠিন বলয় সৃষ্টি করেছেন। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকায় তারা কাউকে তেমন তোয়াক্কা করছেন না। জনসম্পৃক্ততা না থাকলেও মনোনয়ন আদায় করতে পারলেই আবার এমপি হবেন এমন প্রত্যাশায় রয়েছেন তারা। মনোনয়ন তাদের বিপরীতে গেলে বিরোধী পক্ষের চেয়ে এসব নেতাই দলীয় প্রার্থীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন এমন

অভিযোগ ঢাকা বিভাগের এই নেতার।

রাজনৈতিক দলের সংঘাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত জরিপ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। রাজনৈতিক বিষয়ে সর্বশেষ আগস্ট মাসে প্রকাশিত তাদের জরিপের ফলে দেখা গেছে, অন্য দলের সঙ্গে সংঘাতের চেয়ে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই বেশি প্রাণ ঝরেছে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগে ৫৭টি সংঘাত হয়েছে। এসব সংঘাতে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৬৯৪ জন। জরিপের ফলে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের মধ্যে ৪টি সংঘাত হয়েছে। এতে ১৭ জন আহত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে একটি সংঘাতে ২ জন আহত হয়েছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগে ৪টি হামলা পাল্টাহামলার ঘটনায় দুজন নিহত ও ২৮ জন আহত হয়েছে। যুবলীগ ও যুবলীগের একটি সংঘাতে ৮ জন আহত হয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ১২টি দ্বন্দ্বে ১১২ জন আহত হয়েছে।

এর পর গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও এই দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।

কোন্দলের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে ভোলার লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলায়। এখানে জনসংযোগ করতে গেলেই স্থানীয় এমপি নুরুননবী চৌধুরী শাওনের অনুসারীদের বাধার মুখে পড়তে দেখা গেছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের। ফাঁসানো হচ্ছে মামলার জালেও। গত জুন মাসের ২৫ তারিখ দিনভর হামলার শিকার হন আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য ও লালমোহন তজিমুদ্দিন সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার আবু নোমান হাওলাদারের অনুসারীরা। শারীরিকভাবে আহত করা হয় কয়েকজনকে। গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যার পর লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের হাজিরহাট বাজারের চরভূতা ইউনিয়নের হরিগঞ্জ বাজারে ফের সংঘাত হয়।

অভিযোগের বিষয়ে  নুরুননবী চৌধুরী শাওন বলেন, ‘আমি কাউকে বাধা দিতে যাব কেন? কারও যদি লোক থাকে, জনভিত্তি থাকে, তাহলে যাক। এতে আমার তো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু অনেককে দেখছি ঢাকায় বসে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মনোনয়ন চাচ্ছেন। এলাকায় তাদের লোক না থাকলে এলাকায় যাবেন কীভাবে? আমি তিনবার এমপি হয়েছি। আমাদের শিকড় অনেক গভীরে।’

মামলা দিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের হয়রানি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে শাওন বলেন, ‘আমি কাউকে মামলা দিইনি, বাধাও দেয়নি। কেউ যদি মাদক বিক্রি করে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে, অন্যায় করে, তাহলে তো মানুষ মামলা করবেই।’

জানা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাসেম সরদার ৪০ লিটার দুধ দিয়ে গোসল করে বিএনপিতে যোগদান করেন। তার অভিযোগ, ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুম সহ্য করলেও এর মূল্যায়ন পাননি। তার আশপাশের ত্যাগী নেতারাও দলীয় পদ ও মনোনয়নবঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়াও শরীয়তপুরের রাজনীতিতে কোন্দল ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। মনোনয়ন প্রত্যাশায় জনসংযোগকালে শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল আউয়াল শামীমকে প্রকাশ্যে ধাওয়া করতেও দেখা গেছে।

অন্যদিকে নেত্রকোনার একটি উপজেলায় ৩৮ নেতাকর্মী লাইভ অনুষ্ঠান করে দল ত্যাগ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তারা স্থানীয় নেতৃত্বের কোন্দলকে দায়ী করেছেন। ওই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মাঠে নামলে বা সভা-সমাবেশ করতে গেলেই ঘটছে বিপত্তি।

অক্টোবরের প্রথম দিনে চাঁদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী রেদওয়ান খান বোরহান ডিবিসি টিলিভিশনে লাইভ দেওয়ার সময় তার ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় তাকে এবং তার অনুসারী অন্তত ২০ জনকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। ভাঙচুর করা হয় কয়েকটি গাড়ি। সংবাদ সম্মেলনে রেদওয়ান খান বোরহান অভিযোগ করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ‘বহুল বিতর্কিত’ ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান নিজে তার বাহিনী নিয়ে এসে হামলা করে। স্থানীয় এক সাংবাদিক এই ঘটনার ভিডিও করতে গেলে তাকে প্রহার করাসহ মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, সেলিম খান আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার অনুসারী।

ভালুকার সংসদ সদস্য কাজিম উদ্দিন আহাম্মেদ ধনুর বিরুদ্ধে নিজস্ব বলয় তৈরি করে রাজনীতি করার অভিযোগ আছে। নিজ দলের নেতাকর্মীদের মামলায় ফাঁসানোসহ নেতাকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে দলের কেন্দ্রে পাঠানো একটি চিঠিতে। এতে উল্লেখ করা হয়, এমপি ধনু তার অনুসারীদের দিয়ে করানো মামলায় ময়মনসিংহের ভালুকায় মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার মো. মহিউদ্দিনের ছোট ভাই সালাউদ্দিন সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে ফাঁসানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে মো. মহিউদ্দিন সরকারের ছোট ভাইকে। যদিও কাজিম উদ্দিন আহাম্মেদ ধনু আমাদের সময়কে বলেন, এর সত্যতা নাই। তিনি বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে মামলা করেছি এর একটা নজির কেউ দেখাতে পারবে না।’

ঝালকাটির রাজাপুর কাঠালিয়ার সংসদ সদস্য বিএইচ হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে দলের কেন্দ্রে। ওই আসনের ২৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে চিঠি পাঠান। এতে উল্লেখ করা হয়, এমপি বিএইচ হারুন করোনাকালেও সে অর্থে মানুষের পাশে দাঁড়াননি। এখনো সেভাবে তাকে দেখা যায় না। তবে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কিংবা সরকারি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া হয় এমন অভিযোগ উল্লেখ করা হয় এই চিঠিতে। এর সত্যতা জানতে বিএইচ হারুনের ফোন নম্বরে টানা দুদিন কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

দলীয় কোন্দলের জের ধরে ঢাকা-১৪ আসনে শাহ আলম নামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছে। এ নিয়ে মিরপুর এলাকায় বইছে ক্ষোভ। যেকোনো সময় আরও হতাহতের শঙ্কা রয়েছে বলে আশঙ্কা করেন স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির ফাঁসি দাবি করে তার ছবি সংবলিত পোস্টার সাঁটাতে দেখা গেছে।

১৬ অক্টোবর ঝিনাইদহের শৈলকুপায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে হাবিবুর রহমান রিপন নামে এক ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আহত হন আরও দুজন। এ সময় উভয়পক্ষের ৫০টি বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। রবিবার রাত ২টার দিকে মিনগ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রিপন আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নিহতের বাবা আবুল কালাম আজাদ ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে কোন্দল চরমে। মহানগরের দুই অংশে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দ্বন্দ্বে কমিটির কাজও বিলম্বিত হচ্ছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমও। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান ও ড. আবদুর রাজ্জাককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর গত বুধবার মহানগরের সাংগঠনিক কাজে গতি বাড়াতে দলের আরও দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেন বেশ কিছু জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছেছে।

দলীয় কোন্দল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান  বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের নেত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন শত ফুল ফুটবে; কিন্তু সুন্দর ফুলটা উনি বেঁচে নেবেন। তাই বলে অন্য জনের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য নিজের পজিশনকে হাইলাইট করা এগুলো দল একসেপ্ট করবে না। নেত্রী বলেছেন এসব অভিযোগ থাকলে এবং তা যদি প্রমাণ হয় তা হলে তাদের মনোনয়নও দেওয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘নৌকা যার, আমরা সবাই তার। অর্থাৎ যে নৌকার মনোনয়ন পাবে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। এমন ধারণা নিয়েই আমাদের নেতাকর্মীরা কাজ করছে। ফলে কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশীকে বাধা দেওয়ার সুযোগ নাই। এ বিষয়ে অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই কঠোর হয়ে তা নিরসনের চেষ্টা করব।’

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ