নিজস্ব প্রতিবেদক
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারির নামে দুর্নীতি আর লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে তার ৫শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ জব্দ করার পর অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে তিনি ফের দেশে ফিরে এসেছেন। এখন চাইছেনÑ দেশে তিনি নামে-বেনামে যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, সেগুলো বিক্রি করে দুবাই বা মালয়েশিয়ায় চলে যাবেন। সেখানেই ব্যবসাপাতি করে স্থিতু হবেন। এসব তথ্য গোয়েন্দা সূত্রের। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নিশ্চিত, মিঠু বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন। তিনি যেন কোনোভাবেই বিদেশে যেতে না পারেন, সে জন্য তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কমিশন। পাশাপাশি তার ওপর নজরদারিও রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নানা অপরাধে ইতোমধ্যে দুদক তার
প্রায় ৭৪ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয়েই মিঠু দেশে ফিরে আসার সাহস পেয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি বেশ বড়াই করেই বলেনÑ কেউ তার টিকিটি ছুঁতে পারবে না। উপরন্তু ফের তিনি তার অপকর্মের সিন্ডিকেট চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন বলেও জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিঠুর কথিত ঘনিষ্ঠজন দেশের স্বাস্থ্য খাতের শীর্ষপর্যায়ে আসীন হওয়ার পর থেকেই এ খাতে তার অপতৎপরতা বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে সে পুরো খাতেই নিজের প্রভাব বিস্তার করে।
মিঠুর নিউইয়র্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনে নামে-বেনামে কেনা বাড়ি রয়েছে। দেশের বিভিন্ন শহরে নামে করা সম্পদ। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বানানী ও রংপুরে রয়েছে তার বিলাসবহুল বাড়ি। এসব তথ্য আমাদের সময়ের হাতে এসে পৌঁছেছে।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, তার কাছে তথ্য রয়েছেÑ শিগগিরই মিঠু এ দেশে তার যত অর্থ-সম্পদ আছে, সব গুছিয়ে নিয়ে দুবাই পাড়ি দেবেন। তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে এ নিয়ে প্রাথমিকভাবে শলা-পরামর্শও করছেন। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর গত ১৬ অক্টোবর থেকে মিঠুকে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দা সংস্থা। দুদকের ওই কর্মকর্তা জানান, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা পেলে মিঠুকে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি আরও জানান, মিঠু অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তার বাসায় বর্তমানে অবস্থান করছেন।
দুদকের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও আইএইচটি সিলেটসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করার নামে মিঠুর ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে পুকুরচুরি করেছেন মিঠু। যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও এর বিপরীতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছেন, সেগুলোও বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে ভুয়া স্টিকার লাগানো। কখনোবা দিয়েছেন নতুন মেশিনের পরিবর্তে রিকন্ডিশন্ড মেশিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ে গড়া সম্পদ এবং সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে তার ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। বিশ^জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা পানামা পেপারে অর্থপাচারকারী হিসেবে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর পাশাপাশি তার ভাই মোকসেদুল ইসলাম এবং ভাগ্নে বেনজির আহমেদের নাম পর্যন্ত উঠে এসেছে।
২০১৭ সালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে দুদক একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। ওই সময় মিঠু দুদক থেকে সম্পদবিবরণী দাখিলের নোটিশ প্রাপ্তির পরও দাখিল না করায় তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬(২) ধারা; মামলা নং-১১; তারিখ ১০ মে ২০১৬), যদিও এ মামলায় মিঠু থেকে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠুর প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। তিনি কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মালামাল সরবরাহ না করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পর একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেন এবং তৎপরবর্তীকালে তিনি নিজেও আত্মগোপন করেন।
২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্রেট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া লেংকিন মার্চেন্ডাইজ, সিআর মার্চেন্ডাইজ ও এলআর এভিয়েশন, জিইএফ অ্যান্ড ট্রেডিং, ট্রেড হাউস, মেহেরবা ইন্টারন্যাশনাল, ক্রিয়েটিভ ট্রেড, ফিউচার ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি (প্রা.) লিমিটেড, টেকনো ট্রেড, বিলিয়ার এভিয়েশন, সিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং, হ্যাভ ইন্টারন্যাশনাল, লেসিকোন হসপিটালেট, নর্থ ট্রেড নামের ঠিকাদারি ফার্মের নামে এসব হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, অফিস সহকারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন মিঠু।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশে থাকা হাজার-হাজার কোটি টাকার সম্পদক বিক্রি করে নতুন করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। কিছুদিন যাবৎ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার নামে থাকা সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন মিঠু। এমনকি নামে-বেনামে থাকা তার সব অর্থ-সম্পদ নিয়ে এবার দুবাই, মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার ঠেকাতে গোয়েন্দারা সক্রিয় হলেও নানা অপকৌশলে নিজের মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছেন মিঠু। এক্ষেত্রে শীর্ষপর্যায়ের এক আমলার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতির দায়ে বিদেশে তার সম্পদ জব্দ হলেও দেশে ভীষণ কৌশলী মিঠু। বিভিন্ন সময়ে তার অপকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর সংবাদ প্রকাশ হলেও আইনি কোনো জালে এ পর্যন্ত তাকে ধরা যায়নি।
সম্পত্তি ক্রোক ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
দেশেই আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি জানতে পেরে মিঠুর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক। একই সঙ্গে তার স্থাবর ও অস্থাবরসহ মোট ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকা মূল্যের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান স্বাক্ষরিত নিষেধাজ্ঞার একটি চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো হয়। মহানগর সিনিয়র দায়রা জজ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
দুদক বলছে, মিঠু মূলত সিন্ডিকেট করে অতি উচ্চমূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ করতেন। একই সঙ্গে দরপত্র অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন এবং অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত মালামাল সরবরাহের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মিঠু সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে প্রভাব বিস্তার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ কমিশনে অনুসন্ধানাধীন। অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি আমাদের গোয়েন্দার তথ্য ছাড়াও গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি, উনি বর্তমানে দেশেই অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, মিঠুর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে মিঠুর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মিঠুর বিরুদ্ধে মামলা না করার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে দুদক সচিব বলেন, আমাদের আইন ও বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে হয়। এ জন্যই মামলা করা হয়নি।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫ অক্টোবর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মিঠুর ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছেÑ নিউইয়র্কের ব্রংকসে তার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট।
মিঠুর কাছের লোকজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন, যার বর্তমান বাজারদর দাঁড়িয়েছে ৪ মিলিয়ন ডলারে। ওই দেশে হোটেল-মোটেল ব্যবসারও শিকড় গেড়েছিলেন মিঠু। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক তিনি, যার পরিচালক হওয়ার জন্য তাকে লগ্নি করতে হয়েছে প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসেও মিঠুর দুটি দোকান রয়েছে, যেগুলোর মূল্য এক মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ম্যানহাটনে ১৫ মিলিয়ন ডলারে কেনা একটি অফিস রয়েছে মিঠুর। এ ছাড়া ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় তার আরও দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যা মার্কিন সরকার সম্প্রতি জব্দ করেছে মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, মার্কিন মুলুকে মিঠুর বিপুল পরিমাণ সহায়-সম্পত্তির তথ্য সম্পর্কে জ্ঞাত নয় দুদক; জব্দের খবরও তাদের অজানা। দুদক সচিব মাহবুব হোসেন একথা জানান।
যার বিরুদ্ধে ঠিকাদারির নামে পুকুরচুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটসহ অর্থপাচারের এন্তার অভিযোগ, সেই মিঠুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায়। তার ব্যবহার করা মোবাইল নম্বরে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি নম্বরটি বন্ধ থাকায়।