অনলাইন ডেস্ক
দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপ হবে কি না সেটি এখনো অনিশ্চিত। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং মতপার্থক্য যেভাবে দৃশ্যমান হয়েছে তাতে আলাপ আলোচনা বা একটি অর্থবহ সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। এ অবস্থায় আলোচনার জন্য দুই দলকে একটেবিলে বসাতে মধ্যস্থতা দরকার বলেও মনে করছেন নাগরিক সমাজের কেউ কেউ।
সবদলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আলোচনা এবং সমঝোতা খুবই দরকার বলে মনে করছেন অনেকে।
নাগরিক সমাজ এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক এমনকি নির্বাচন কমিশনও মনে করে দুই দলের মধ্যে অর্থবহ সংলাপ প্রয়োজন। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই দলই পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থান নিয়েছে।
একদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে যেতে চায় না। অন্যদিকে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে বিএনপি। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে বাধ্য করা এখন বিএনপির টার্গেট।
রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে একটি অর্থপূর্ণ সংলাপ কেন সম্ভব হচ্ছে না? এ প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে দায়ী করছেন। এটা তো আমাদের দায়িত্ব না। দায়িত্বটা সম্পূর্ণভাবে সরকারের। যারা সরকারে আছেন। ড্রাইভিং সিটে যিনি থাকেন তাকেই গাড়ি কীভাবে চালাবে না চালাবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়- বিবিসি বাংলাকে বলেন মির্জা ফখরুল।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ভুল করে হোক, ফ্রড করে হোক – এখন তারাই আছে। তাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করবে।
বিএনপি মহাসচির বলেন, বিএনপি সংলাপের বিরুদ্ধে নয়। তারা তো পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনাই হবে না। শর্তযুক্ত আলোচনা হবে না। আমাদের কথা খুব পরিষ্কার- আমরা আলোচনায় যাব না একথা কখনোই বলছি না।
আমরা সেই আলোচনায় যাব যেটা অর্থবহ হবে, যেটা সবাই বলছে। সেই অর্থবহ সংলাপটা তখনই হবে যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলছেন, সংলাপের জন্য যে ‘পরিবেশ দরকার’ এখন সেটি অনুপস্থিত। আলোচনার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সেই বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলে প্রস্তুত বিএনপি।
বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে বিএনপির বর্তমান অবস্থান বেশ কঠোর। কারণ হিসেবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।
আমরা সংলাপে গিয়েছি আমরা কথা বলেছি শেখ হাসিনার সঙ্গে, তার টিমের সঙ্গে। কোনো লাভ হয়নি।
আমাদের যে কথাগুলো ওনার দিয়েছিলেন সেগুলো পুরোপুরি বেমালুম তারা ভুলে গিয়ে তারা সমানে নির্যাতন, অত্যাচার, গ্রেপ্তার চালিয়ে গেছেন। এবং নির্বাচনটাকে একটা প্রহসনে পরিণত করেছেন। আগের রাতে নির্বাচন করেছেন।
এবার সমাধান তাহলে কীভাবে হবে?
এ প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের সমাধান যেটা সেটা আমি বলতে পারি। আমরা তো জনগণ নিয়ে আন্দোলন করছি। আমরা ঘোষণাই দিয়েছি যে, আমরা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারকে বাধ্য করব আমাদের দাবিগুলো মেনে নিতে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগও একটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির শর্ত মেনে কোনো সংলাপের প্রয়োজনীয়তাই দেখছে না ক্ষমতাসীন দল।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে শর্তযুক্ত কোনো সংলাপ হবে না। সংলাপের ব্যাপারে দলটি চিন্তা করবে যদি বিএনপি তাদের চারটি শর্ত প্রত্যাহার করে।
সংলাপ করতে আওয়ামী লীগ কেন উদ্যোগ নিচ্ছে না?
এ প্রশ্নে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সংবিধান মেনে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হলেই বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে।
তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় যেটা সংবিধানবিরোধী। তারা বলছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে মেজরিটি হারালে পদত্যাগ করেন। তিনি তো পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাননি।
তারা বলছে যে, সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে বিলুপ্ত করতে হবে। সুতরাং এই ধরনের দাবি-দাওয়া যখন তারা দিচ্ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার কোনো প্রয়োজনই নাই, বলেন ফারুক খান।
তিনি বলছেন, যদি বিএনপি তাদের ‘সংবিধানবিরোধী দাবি’ পরিত্যাগ করে, তারা এই কথা বলে যে তারা আগামী নির্বাচনে আসতে চায় এবং একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় সে লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে বসতে চায়, সেক্ষেত্রে সরকার এটাকে বিবেচনা করতে পারে বলে আমি মনে করি।
১৯৯০ পরবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে চারদফা আলোচনা বা সংলাপ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ এবং ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি দুই দলের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করেছিল।
বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে -বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে অর্থবহ সংলাপের জন্য যে আন্তরিকতা বা ইতিবাচক মনোভাব দরকার, সেটি দুই দলের তরফেই অনুপস্থিত। তাছাড়া এবার এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি কোনো মধ্যস্থতাকারী নেই বা কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।
দুই দলের সংলাপে মধ্যস্ততা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেন, কোনো মধ্যস্থতাকারী তো দেখছি না। বরঞ্চ একমাত্র এবারই দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে এনডিআই এবং আইআরআই যে টিম এলো তারাই প্রস্তাবগুলো দিয়েছে। তাও তারা কোনো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কোনো ভূমিকা পালন করছে বলে আমার জানা নাই।
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে কোনো সমঝোতায় না এলে দেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে সমস্যা সমাধানে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
নির্বাচন বিশ্লেষক এবং ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ বলেন, দেশের স্বার্থেই দুই দলকে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।
তাদের একত্রে বসার কোনো বিকল্প নেই। তাদের একত্রে বসে অবশ্যই একটা আস্থার জায়গা আসতে হবে। হাতে তিন মাস বা দুই মাস সময় আছে তাদের বসতে হবে। তাদের একত্রে না বসাটা হবে এই দেশের প্রতি অন্যায় করা দেশের মানুষের প্রতি প্রচণ্ড অবিচার করা।
এই মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপের জন্য একটি মধ্যস্থতা হওয়ার প্রয়োজন দেখছেন শারমীন মুরশিদ।
মধ্যস্থতা খুবই খু্বই দরকার। এটা রাজনীতির বাইরে থেকে যদি হতো তাহলে সবচেয়ে ভালো হতো। সুশীল সমাজের বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেনের সম্মানীত ব্যক্তিদের উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে এটা কীভাবে হবে, কার মাধ্যমে হবে সেটা বড় প্রশ্ন।
এক্ষেত্রে আমাদের বড় দুর্বলতাটা হচ্ছে, সুশীল সমাজের সেই জায়গাটা এখন আর নেই। তবে এখনো যেমন রেহমান সোবহান বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো যারা আছেন, তারা এগিয়ে আসবেন কি না জানি না। দলগুলো হয়তো তাদের কথা শুনতে পারে,’ বলেন শারমীন মুরশিদ। -বিবিসি বাংলা