আইডিয়াল স্কুলে ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পেয়েও ৯৯ শিক্ষক বহাল ওই সব নিয়োগ বাতিল করে বেতন হিসেবে নেওয়া প্রায় ২৭ কোটি টাকা জমা দেওয়ার সুপারিশ ডিআইএর।

আইডিয়াল স্কুলে ‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পেয়েও ৯৯ শিক্ষক বহাল ওই সব নিয়োগ বাতিল করে বেতন হিসেবে নেওয়া প্রায় ২৭ কোটি টাকা জমা দেওয়ার সুপারিশ ডিআইএর।

বিশেষ প্রতিবেদকঢাকা

রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিয়ম ভেঙে ১১১ জন শিক্ষক নিয়োগের তথ্য পেয়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। ওই শিক্ষকদের মধ্যে ৯৯ জন বর্তমানে কর্মরত। তাঁদের নিয়োগ বাতিল করে বেতন হিসেবে নেওয়া প্রায় ২৭ কোটি টাকা কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।

শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা খাতে নিয়ম ভাঙার চিত্র উঠে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি সংস্থা ডিআইএর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করার দায়িত্বে নিয়োজিত।

আরও পড়ুন
‘মুশতাক–কাণ্ড’ ছাড়াও যেসব বিতর্কে সুনাম হারাচ্ছে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল
ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের পরিদর্শন দল দীর্ঘদিন কাজ করে ১২ অক্টোবর তাঁদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ১৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, শিক্ষক নিয়োগের অনিয়মগুলো অধিকাংশই হয়েছে ২০১১ এবং ২০১৩ সালে। এরপরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি পরিচালনা কমিটির এক সদস্যের ‘অনৈতিক কাজ’, এক সহকারী শিক্ষকের প্রশ্নপত্র ফাঁসে যুক্ত হওয়ার অভিযোগসহ বিতর্কিত কিছু ঘটনায় একসময়ের ‘নামকরা’ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম হারাচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।

ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াল স্কুল এখন মতিঝিলের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদায় শাখা ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ হাজার। আর শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন সাত শতাধিক।

সম্প্রতি পরিচালনা কমিটির এক সদস্যের ‘অনৈতিক কাজ’, এক সহকারী শিক্ষকের প্রশ্নপত্র ফাঁসে যুক্ত হওয়ার অভিযোগসহ বিতর্কিত কিছু ঘটনায় একসময়ের ‘নামকরা’ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম হারাচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
বিদ্যালয়টির নানা অভিযোগের বিষয়ে গত বছর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা শুরু করে ডিআইএ। সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী এখন এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জবাব দেবে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

‘আমি এখনো প্রতিবেদনটি দেখেনি। তবে ডিআইএ ভুল করার কথা না। পরিচালনা কমিটির সঙ্গে বসে পর্যালোচনা করে অবস্থান জানাব।’
মিজানুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল

নিয়ম ভেঙে শিক্ষক নিয়োগ
পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের মে মাসে পরিচালনা কমিটির (জিবি) অনুমোদনের মাধ্যমে ১১১ জন শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগের তথ্য পর্যালোচনা করে গুরুতর অনিয়মের তথ্য পেয়েছে ডিআইএ। এ বিষয়ে ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখায় (ব্রাঞ্চ) সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫৯ জন শিক্ষক ও ৪ জন ল্যাব সহকারী নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু পরে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, যা অবৈধ। তৎকালীন পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তে ইচ্ছেমতো শাখা সৃষ্টি করে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডিআইএ দেখতে পায় ওই সময় নিয়োগ পাওয়া ১১১ জন শিক্ষকের মধ্যে বর্তমানে ৯৯ জন কর্মরত। সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরা সরকারি জাতীয় স্কেল অনুযায়ী বেতন–ভাতা নিয়েছেন।

আরও পড়ুন
এবার পদত্যাগ করলেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ
আবার এই নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্নকালে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটি ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের পরিপত্র অনুযায়ী, কোনোভাবেই অস্থায়ী কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে না। সুতরাং ওই সময় নিয়োগ পাওয়া ১১১ জন শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারীর নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। তাই তাঁদের নিয়োগ বাতিলযোগ্য।

ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্য পদত্যাগ করা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফওজীয়া রাশেদীসহ ১৭ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রাপ্য বেতন–ভাতার বাইরে মোট ২২ লাখ ২ হাজার ১৪০ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে ফওজীয়া রাশেদী ছয় বছরের অভিজ্ঞতায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এ কারণে আপত্তি জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে ৯৯ জন শিক্ষকের তালিকাও দিয়েছে ডিআইএ। এই দীর্ঘ সময়ে একেকজন শিক্ষক মোট বেতন নিয়েছেন ২৭ লাখ ১৫ হাজার ৬০০ টাকা করে। এই হিসেবে প্রায় ২৭ কোটি টাকা নিয়েছেন।

শিক্ষক নিয়োগে ওই অনিয়ম ছাড়াও আরও কিছু অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ডিআইএর প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০১৩ সালে ১৪২ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ ওই সময় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখার চাহিদা অনুযায়ী, বিভিন্ন বিষয়ের সৃষ্ট পদে ৯৪ জন শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান  বলেন, ‘আমি এখনো প্রতিবেদনটি দেখিনি। তবে ডিআইএ ভুল করার কথা না। পরিচালনা কমিটির সঙ্গে বসে পর্যালোচনা করে অবস্থান জানাব।’

২২ লাখ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্য পদত্যাগ করা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফওজীয়া রাশেদীসহ ১৭ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রাপ্য বেতন–ভাতার বাইরে মোট ২২ লাখ ২ হাজার ১৪০ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে ফওজীয়া রাশেদী ছয় বছরের অভিজ্ঞতায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এ কারণে আপত্তি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচজন নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষক ৩০ লাখ ২৭ হাজার ১৪০ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন। এসব টাকা ফেরতযোগ্য বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফওজীয়া রাশেদী মুঠোফোনে বলেন, তিনি এখনো এই প্রতিবেদন দেখেননি। দেখার পর উত্তর দেবেন।

‘শিক্ষা প্রশাসনের প্রতি অবজ্ঞার শামিল’
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল ক্যাম্পাসের মাধ্যমিকের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার অনুমতিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া দ্বিতীয় পালা (ডাবল শিফট) চালু, মূল শাখার ইংরেজি ভার্সন, প্রাথমিকের প্রথম স্বীকৃতি, ইংরেজি ভার্সনের দ্বিতীয় পালা চালুর অনুমতিপত্রও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ডিআইএ বলছে, অনুমতিবিহীনভাবে এসব কোর্স কীভাবে চালু আছে, তা সত্যিই বিস্ময়ের ও উদ্বেগের। এটি দেশের শিক্ষা প্রশাসনের প্রতি অবজ্ঞার শামিল। এ জন্য ডিআইএ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী ক্যাম্পাসটি ১৯৯৬ সালে চালু হয়। কিন্তু এই ক্যাম্পাস চালুর কোনো অনুমতিপত্র নেই। এ ছাড়া মাধ্যমিকের ব্যবসায় শিক্ষা শাখা, বনশ্রীর দ্বিতীয় পালার শাখাসহ কয়েকটি বিষয়ের অনুমতিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই শাখার এমপিও না দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।

জানতে চাইলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর  বলেন, তাঁরা এই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও দিয়েছেন। এখন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জবাব দেবে, তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী ক্যাম্পাসটি ১৯৯৬ সালে চালু হয়। কিন্তু এই ক্যাম্পাস চালুর কোনো অনুমতিপত্র নেই। এ ছাড়া মাধ্যমিকের ব্যবসায় শিক্ষা শাখা, বনশ্রীর দ্বিতীয় পালার শাখাসহ কয়েকটি বিষয়ের অনুমতিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই শাখার এমপিও না দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।

শিক্ষা শীর্ষ সংবাদ