দিন দিন বাড়ছে মোটরসাইকেলের ব্যবহার। সেই সাথে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, অন্যান্য সব চার চাকার যানবাহনের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, দেশের মোট মোটরযানের ৭১ শতাংশই হচ্ছে মোটরসাইকেল। সংখ্যায় হিসাব করলে প্রায় ৫০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল প্রতিনিয়ত রাস্তায় চলছে। শুধুমাত্র রাজধানীর সড়কে ১৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চলছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে ৭১৬টি দুর্ঘটনায় ৬৮৫ জন নিহত এবং ৬০৬ জন আহত হয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে ২২৪টি দুর্ঘটনায় ১৮৩ জন নিহত এবং ২৪৩ জন আহত হয়েছে। গণপরিবহন সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। তবে মোটরচালকের অধিকাংশই হলো কিশোর-তরুণ ও যুবক বয়সের।
আজ ২২ অক্টোবর জাতীয় সড়ক দিবস। সারা দেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত করা হলেও সড়কের দুর্ঘটনা কিছুতেই কমাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু দিবস পালন করলেই হবে না, সড়ক নিরাপদ রাখতে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মাঝে ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা তৈরি করতে পারেনি। তাছাড়া মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা করে লেন তৈরি করতে পারলে দুর্ঘটনা প্রবণতা কমে যাবে। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও কম নয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৮ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৪০ বছর। এই শ্রেণির মোটরসাইকেল চালকদের নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালানো জরুরি। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণন কোম্পানিগুলোকে এই সচেতনতা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। মোটরসাইকেলের ব্যবসা থেকে বছরে ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকা উপার্জন হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা মানবসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকে কারো নজর নেই।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোট দুর্ঘটনা হয়েছে ২৫ হাজার ৯২৪টি। দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার একজন। শুধুমাত্র মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৯ হাজার ৩০৯ জন। তার মধ্যে ২০১৯ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছ ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে মারা গেছে এক হাজার ৪৬৩ জন মোটরবাইক আরোহী। ২০২১ সালে মারা গেছে দুই হাজার ২১৪ জন মোটরসাইকেল চালক। ২০২২ সালে বাইক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৯১ জন। তাছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫৯৬ জন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, দেশে পাঁচ লাখ ফিটনেসবিহীন মোটরযান রয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাটা প্রকৃতপক্ষে কয়েকগুণ বেশি। সড়কে উঁচু করে স্পিড ব্রেকার তৈরি করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাদা রঙ না করার কারণে দূর থেকে স্পিড ব্রেকার বুঝতে না পারায় প্রতিমাসেই ১০ থেকে ১২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। পথচারী নিহতের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং ৫৮ শতাংশ দায়ী পথচারীদের অসতর্কতা।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, সরকার ৩৭৫ সিসি মোটরসাইকেল নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে। এ ধরনের মোটরসাইকেলের জন্য দীর্ঘ ও একমুখি সড়ক প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের সড়ক নাই বললেই চলে। সড়কে স্বল্পগতির যানবাহন এবং পথচারীরা এলোমেলোভাবে চলাচল করে। ফলে বাইকের চাপা-ধাক্কায় পথচারী নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই অবস্থায় ৩৭৫ সিসির ভারী ও দ্রুতগতির মোটরসাইকেলের অনুমতি দেয়ার মানে দুর্ঘটনাকে আলিঙ্গন করা। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই ঠিকমতো আলোর মুখ দেখছে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সমন্বিত পদ্ধতিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে নিরাপদ সড়কে সাফল্য আনতে পারছে না। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না জানা ও না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা এবং সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের উপরে হাট-বাজার গড়ে উঠা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। রাজধানীর পুরোনো বাস প্রত্যাহার করে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চার হাজার আধুনিক নতুন বাস এসি, নন এসি এবং সাধারণ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে রুট ফ্রান্সাইজ পদ্ধতিতে পরিচালনা এবং আলাদা লেনের ব্যবস্থা করলে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারী বহু মানুষ বাসে চলাচল করবেন। যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের উপরে উঠালে দুর্ঘটনার ঝুঁকি চারগুণ বৃদ্ধি পায়। যানবাহনে আঘাত করে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রে মহাসড়কে যানবাহনের দাঁড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড’ গঠনের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এই ফান্ডে প্রতিবছর সর্বোচ্চ তিন হাজার কোটি টাকা হলেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সম্ভব। যেসব উৎস থেকে ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ সংগ্রহ করা হবে, সেসব উৎসসহ পুলিশ কর্তৃক মোটরযান থেকে জরিমানার অর্থের একটি অংশ এবং বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিএসআর ও অনুদান থেকে এই পরিমাণ অর্থ খুব সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। সড়ক পরিবহন আইনে বিদ্যমান ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতা দেয়া শুরু হয়েছে সীমিত পরিসরে। কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সহযোগিতা পাবেন না। তাছাড়া এই ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া সময়সাপেক্ষ এবং দুরূহ। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এই খাতে চলমান দুর্নীতি, চাঁদাবাজি বন্ধ করে টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। তা না হলে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা আমাদের কাছে স্বপ্নই থেকে যাবে।