২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর! রাজনীতিতে প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। ওই দিন রাজধানীতে রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘাত-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগে ইতিহাসে বিশ্ব গণমাধ্যমে স্মরণীয়। বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে গুলি ও মানুষ পিটিয়ে মারার দৃশ্য সারা দুনিয়ায় আলোচিত। যা থেকে ওয়ান-ইলেভেনের জন্ম হয় বলেও ভাষ্য। এবার সেই দিনটিকে টার্গেট করে ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে মহাযাত্রার ঘোষণা বিএনপির। মরণকামড় দেয়ার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি দলটির। ২৬ বা ২৭ অক্টোবর এই মেয়াদের সংসদ অধিবেশনের শেষ দিন। সেই রাতেই ঢাকায় বসে পড়ার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। এ নিয়ে জোট নেতাদের লোকের সংখ্যা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপির যারা সংসদ সদস্য প্রার্থী তাদের রাজপথে পরীক্ষা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা মনোনয়নপ্রত্যাশী তাদের প্রত্যেককে ঢাকায় অন্তত ১০ সহস্রাধিক লোক জড়ো করতে টার্গেট দেয়া হয়েছে। সরকার যদি বাধা দেয় সেখান থেকেই পাল্টা জবাব দেয়া হবে বলেও দলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে আর কোনো সময় দেয়া হবে না। সরকার যদি হামলা বাধা রক্তাক্তের পথ বেছে নেয় তাহলে বিএনপিও পরিস্থিতি বুঝে সাথে সাথে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেবে। যেভাবে সরকার ঠেকবে সে পথেই হাঁটবে তারা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবর বিএনপি বড় জমায়েত করে ঢাকা অচলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুধু নামসর্বস্ব জোট নেতাদের ওপর ভরসা করেই বসে থাকছে না। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত ইসলামপন্থি দলগুলোকেও রাজপথে নামাতে পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক বৈঠক শেষ করেছে বিএনপি। ইতোমধ্যে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম ২৭ অক্টোবর সব জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল এবং ৩ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হকসহ কারাবন্দি ওলামায়ে কেরামের মুক্তি দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে খেলাফত যুব মজলিস। ৩ নভেম্বর ঢাকায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হবে। ১০ নভেম্বর দেশের জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিল হবে। আর আগামী ১ ডিসেম্বর খেলাফত ছাত্র মজলিসের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকায় ছাত্র সমাবেশ হবে।
একই সঙ্গে রাজপথের অন্যতম ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামী আগামী ২৬, ২৭ ও ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বড় শোড়াউন দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে জানা গেছে। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে হেফাজতের জাগরণ স্থানকে টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে তারা। সরকার পতনে ত্রিমুখী স্থান টার্গেট নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি তাদের দলীয় কার্যালয়সহ ঢাকার প্রবেশগুলোতে অবস্থান করবে। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় দলগুলো বায়তুল মোকাররমকেন্দ্রিক। আর জামায়াতে ইসলামী মতিঝিল শাপলা চত্বর নিয়ন্ত্রণ নিতেই তৎপর রয়েছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে এক সময়ের অন্যতম জোটসঙ্গী জামায়াত জোগ দিতে পারে বলেও সম্ভাবনা রয়েছে।
জামায়াতের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এই সরকারের পতনে আমাদের রাজপথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে অবস্থান করব। সরকারকে সরে যেতে আমরা অল্প সময়ের জন্য আল্টিমেটাম দেবো। কিংবা আমাদের অন্য ভাবনা রয়েছে তা এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। তবে সরকার যদি আমাদের বাধা দেয় সংঘর্ষ জড়াতে উসকানি দেয় তখন আমরাও হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। যখনই বাধা পাবো তখন থেকেই লাগাতার কর্মসূচি চলতে থাকবে যা সরকার চিন্তাও করতে পারবে না।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর দেশের রাজনীতিতে অনেক অঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে। অতীতের মতো সংঘাত-সহিংসতাও হতে পারে। অনেক অজানা ঘটনার জন্ম হতে পারে। শক্তি পরীক্ষায় কূটনৈতিক অনেক হিসাব-নিকাশ যোগ হবে। ৩ নভেম্বরের মধ্যে বিরোধীরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে চাইবে। অক্টোবরের শেষ বেলায় তারা ঢাকায় বসে পড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। চরমোনাই ও খেলাফত বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকবে। হেফাজত স্টাইলে মতিঝিল নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া থাকবে জামায়াত। এসব কিছুর মধ্যে যদি বিরোধীরা ব্যর্থ হয় তাহলে ৪ নভেম্বরের পর হয়তো পুরো ঢাকা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
সরকারবিরোধীরা মনে করছে, এবার আওয়ামী লীগের ওপর পশ্চিমা চাপ আছে। মার্কিন ভিসানীতির ভয় আছে প্রশাসনে। অতীতের মতো খুব একটা ভালো সময় নেই। কূটনৈতিক মিশনে অনেক স্নায়ু লড়াই চলছে। সব পরিস্থিতির মধ্যেও ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে রাখার চেষ্টা করবে। ক্ষমতাসীন দলের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির সঙ্গে ২৮ অক্টোবরই বড় সমাবেশ থাকবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর। সেদিন ঢাকায় একটি বড় সমাবেশ করবে তারা। এর বাইরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সতর্ক পাহারায়ও থাকবে। আজ রোববার কর্মসূচি চূড়ান্ত হবে। কী ছকে বিএনপিকে মোকাবিলা করা হবে। পাল্টাপাল্টি এমন অবস্থায় অতীতের রক্তাক্তের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। ২৮ অক্টোবর দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই দিন চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। অল্প সময়ের জন্য তিনি ঢাকার বাইরে থাকবেন। দুপুরের আগেই কর্মসূচি শেষ করে ঢাকায় চলে আসবেন শীর্ষ নেতারা। বিএনপি যাতে কোনো কিছু করতে না পারে পাল্টা অবস্থানে তার জবাব দেয়া হবে। ৪ নভেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিন আওয়ামী লীগ ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করবে। এর আগেই ঢাকায় নেতাকর্মীদের অবস্থানের জন্য হয়তো দলীয় নির্দেশনাও আসতে পারে। বিপুল জমায়েত নিশ্চিত করে রাজপথ ওই দিন থেকেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ভোটের কর্মসূচিতে যাবে আওয়ামী লীগ।
সমপ্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঢাকা অবরোধ করতে এলে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে জমায়েতের চেয়েও করুণ পরিণতি হবে।’ তবে এ নিয়ে বিএনপির জনসমাবেশ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘হেফাজত আর বিএনপি এক নয়, মনে রাখবেন। আপনারা হেফাজতের হাজার হাজার নেতাকে হত্যা করেছেন— এটি এখন স্বীকার করেছেন। এসব খুনের বিচার হবে।’
রাজনৈতিক উত্তপ্ত হওয়ার বিষয়গুলো সমপ্রতি ইসলামপন্থি নেতাদের বক্তব্যের মধ্যেও দেখা গেছে। গত সপ্তাহে মতিঝিলে বড় সমাবেশ করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেছেন, ‘এখন থেকে আমাদের রাজপথে লাগাতার কর্মসূচি থাকবে। জীবন বাজি রেখে আমরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব। এখন থেকেই আপনারা রাজপথে থাকার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত হওয়া ছাড়া আমরা আর রাজপথ ছেড়ে যাব না। ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছেন, ‘আমরা যদি নিশ্চুপ বসে থাকি, তাহলে আমাদের এই জন্মভূমি বাংলাদেশ এক পর্যায়ে আমাদের স্বাধীনতা বিলীন হবে, আমাদের ইসলাম ধ্বংস হবে।’ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাঘ যখন জঙ্গলে হুঙ্কার দেয়, মনে হয় সামনে আর কেউ নেই। কিন্তু দুর্বল প্রাণীগুলো একত্রিত হয়ে বাঘের ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন বাঘও পালাতে বাধ্য হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন, প্রহসনের নির্বাচন ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচন, ডাকাতের নির্বাচন ছিল। আগামী নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হবে না। আগামী নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন হতে দেবো না। দিল্লির গোলামি আমরা মানব না।’
জানতে চাইলে যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুবলেন, ‘১৬ অক্টোবর যুব সমাবেশে যুবদল শক্তির মহড়া দিয়েছে। এটি ছিল আমাদের সেকেন্ড রাউন্ড। ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হবে ফাইনাল রাউন্ড। দেশের তরুণ সমাজকে ১৫ বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এবার জনগণের আন্দোলন সফল হবে এবং মানুষ ফিরে পাবে তাদের ভোটাধিকার। দেশের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে যুবদল সব ধরনের শক্তি প্রয়োগ করবে।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ইতোমধ্যে সারা দেশে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে পড়েছে। অবৈধ সরকারকে বিদায় করার জন্য জনগণ প্রস্তুত। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে সরকারকে ‘না’ জানিয়ে দেবে। সরকার যদি বাধা দেয় যেকোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের অল্প সময়ের নোটিসেও বিশেষ ঘোষণা আসতে পারে। এটিও মনে রাখতে হবে— আন্দোলন কখনো দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয় না। এখন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত আমাদের দলের কর্মসূচি থাকবে। বিএনপি হলো সন্ত্রাসী দল। তাদের বিষয়ে দেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগ সতর্ক। তারা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। তারা যদি রাজপথে কোনো সংঘাত তৈরির চেষ্টা করে তবে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় আওয়ামী লীগ অবশ্যই জনগণের পক্ষে ভূমিকা পালন করবে।’