শাহনাজ পারভীন একজন নারী উদ্যোক্তা। তার মতো শতাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন একজন সাবেক এডমিন ক্যাডারের ছেলে যিনি চক্রের হোতা আরিফ হাসান রনি। ভুক্তভোগী নারী জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখতে পাই ‘আপনার কি লোন প্রয়োজন? কার, ফ্ল্যাট, ল্যান্ড মর্টগেজ লোন-বিষয়ক সহায়তা করে থাকি।’ বিদেশ যাবেন? কিন্তু টাকার জন্য যেতে পারছেন না।’ এই বিজ্ঞাপন দেখে আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করি, সহজ শর্তে উদ্যোক্তা লোন পাস করিয়ে দেবে বলে আমাকে তাদের মতিঝিল অফিসে যেতে বলে। সেখানে গেলে জানায়, লোন পাস হলে এক পার্সেন্ট টাকা দিতে হবে। ফাইল রেডি করার জন্য ২৫ হাজার টাকা প্রথমে দেই এবং পর্যাক্রমে ভুয়া ডকুমেন্টস দেখিয়ে ছয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেসবুকে এসব বিজ্ঞাপন দিয়েই কার্যত বিভিন্ন এলাকায় এজেন্টের মাধ্যমে মক্কেল জোগাড় করেই মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে ঢাকার মতিঝিলে গড়ে উঠা এই চক্র। যে চক্রের হোতা একজন সাবেক এডমিন ক্যাডারের ছেলে। নাম আরিফ হাসান রনি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ দেশের বিভিন্ন শহরে দীর্ঘদিন ধরে অর্থ হাতানোর এমন প্রতারণা চালিয়ে আসছেন তিনি। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসএমই লোন, কৃষি লোন, হোম লোন, প্রবাসী ঋণ ইত্যাদি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েই চক্রটি হাতিয়েছে কোটি কোটি টাকা। পথে বসিয়েছে শত শত পরিবারকে। তিনি একাই নন, তার এই দুষ্টচক্রে রয়েছে আরও পাঁচ সদস্য। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মতিঝিল ও বনশ্রী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— আরিফ হাসান, সুমন, রাসেল, হাবিব ও খন্দকার মো. ফারুক। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের লোনের নকল স্যাংশনপত্র, নকল সিল সাতটি, লোন চুক্তির নকল দলিলপত্র, অফিস রেজিস্ট্রারসমূহ, বিভিন্ন ব্যাংকের নকল লোন আবেদনপত্র, গ্রাহককে প্রদানকৃত নকল মানি রিসিট উদ্ধার করা হয়। তার এসব প্রতারণার কাজে স্ত্রী আফরোজা আক্তার বেবী (৫০), মা সেলিনা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। চক্রের হোতা আরিফের বাবা এডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে ছিল তার জানাশোনা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তোলেন প্রতারণার সাম্রাজ্য। এভাবে বিভিন্ন ধাপে ধাপে এই চক্র মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে ছয় থেকে সাত মাসের মতো সময় লেগে যেত গ্রাহকদের। এর মধ্যে প্রতারক তার অফিস পরিবর্তন করে নতুন করে আবার অফিস নিতেন এমনটি জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ব্যাংক লোনের বাইরেও বিদেশে লোক পাঠানোর নাম করে প্রতারণা, ট্যাক্স ফাইল-ট্রেড লাইসেন্স করে দেয়া, কোম্পানি নিবন্ধন করে দেয়ার নাম করেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় এই চক্র। এ ছাড়াও নতুন জায়গায় অফিস নিয়ে আবার বের করতেন প্রতারণার নিত্যনতুন কৌশল। এই প্রতারক বিভিন্ন সময় নিজেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা করতেন। এসব কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই তার কাছে কোনো ভ্যালিড কাগজপত্র নেই। সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ‘সাইদ আক্তার হোসাইন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লি’ ‘রুনা অ্যান্ড হাসান অ্যাসোসিয়েট’ ‘এসএ হাসান কনসালটেন্সি’ ‘এসএ হাসান ট্যুরস ট্রাভেল অ্যান্ড ইডুকেশন কনসালটেন্সি।’
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘বাবা এডমিন ক্যাডার হওয়ায় সে প্রশাসনের বিষয়গুলো ভালো করেই জানত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরিফ হাসান রনি প্রতারণার এই ফাঁদ তৈরি করে। প্রতারণার টাকায় ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসাও খুলে বসে। তবে তার অনুমোদন নেই এবং সে কোনো ডকুমেন্টসও দেখাতে পারেনি। সে মূলত ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপন এবং বিভিন্ন এলাকায় তার এজেন্টের মাধ্যমে গ্রাহক জোগাড় করে। তার এসব প্রতারণার কাজে স্ত্রী আফরোজা আক্তার বেবী (৫০), মা সেলিনা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। তার স্ত্রীকে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর ইত্যাদি পরিচয় দিতেন। অ্যাডভোকেট মোজাম্মেলকে মাঝে মধ্যে কোম্পানির মালিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। রনির সঙ্গে কারো কোনো ঝামেলা হলে সে বিষয়গুলোও দেখতেন অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল। তিনি বিভিন্ন মানুষকে মামলার হুমকি দিতেন এবং ভয়ভীতি দেখাতেন। এ ছাড়াও অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল তার আইনি বিষয়গুলো দেখতেন। তার নামে আগেও দুটি মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার মতিঝিল থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলার তদন্তে গিয়ে আমরা এই অভিনব প্রতারণার বিষয়ে জানতে পারি। এরপর অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই চক্রে আরও কয়েকজন সদস্য রয়েছে। তারা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। তাদের যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে।
ইলমান খান নামে এক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি ‘ইকো সোসাইটি’ নামক একটি এনজিওর মালিক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এক বন্ধু আমাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে সেটি দেখান। এরপর আমি যোগাযোগ করি। আমার এনজিওর নামে ১০ কোটি টাকা লোন পেতে তার সহায়তা চাই। এরপর আমার আর আরিফ হাসান রনির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়। এ সময় সে আমাকে বিভিন্ন লোনের কাগজপত্র দেখায় এবং নিজে সাবেক যুগ্ম সচিবের ছেলে এবং অ্যাডভোকেট হিসেবে পরিচয় দেয়। এভাবে বিশ্বাস অর্জন করে সে। এরপর প্রথমে প্রসেসিং ফির নামে দুই লাখ টাকা নেয়। এরপর একটি স্যাংশন লেটার দেয়। এভাবে ধাপে ধাপে সে আমার কাছ থেকে ২১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।’ এরপর লোন না হওয়ার টাকা ফেরত চান ইলমান খান। টাকা দেবো দেবো বলে প্রথমে কয়েক দিন ঘুরায়। ইলমান খান বলেন, ‘এরপর আমি তাকে চাপ দিলে তার অফিস থেকে আমাকে ২০ লাখ টাকার একটি চেক দেয়া হয়। তবে সেই চেক ব্যাংকে জমা দিলে বাউন্স হয়। এতে তার সঙ্গে আমার একটু ‘হট টক’ হয়। এরপর সে আমাকে গুম করে ফেলার হুমকি দেয়। সে জানায়, তার স্ত্রী নাকি হোম মিনিস্টারের ভাগ্নি। সে আমাকে উঠিয়ে নেয়ার হুমকি দেয়। এরপর নিরূপায় হয়ে আমি আইনের আশ্রয় নেই।
এ ছাড়াও আরও ১২ জন ভুক্তভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের থেকে প্রায় ৫৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। যাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের মো. জালাল উদ্দিনে কাছ থেকে ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকা, কেরানীগঞ্জের শাহনাজ পারভীন নামে একজনের কাছ থেকে ছয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার, বাসাবোর বাগপাড়ার রাকিবা খাতুনের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা, উত্তর বাড্ডার সাতারকুল রোডের সানোয়ার হোসেনের কাছ থেকে দুই লাখ ৮৮ হাজার ১১৪ টাকা, গাজিপুরের মোফাজ্জল হোসেন জুয়েলের কাছ থেকে দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা, রাজশাহীর বাঘার মো. শাহিন আলমের কাছ থেকে এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা, নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের মো. সজিবের কাছ থেকে এক লাখ টাকা, উত্তরা ৪ নং সেক্টরের তাইবুর রহমানের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, নারায়ণগঞ্জের বিল্লাল হোসেনের কাছ থেকে নগদ ৩৫ হাজার টাকা ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট ২৫ লাখ টাকার ও দলিলের ফটোকপি স্বাক্ষর দিয়ে নিয়েছে, যশোরের সারসার মো. আবিদ হাসানের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং কেরানীগঞ্জের মনিরুল ইসলামের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, ভুক্তভোগীর সংখ্যা ন্যূনতম ১০০ জন হবে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, লোন বা আর্থিক কাজের জন্য সরাসরি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কোনো আর্থিক লেনদেনের আগে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যাচাই করে নিতে হবে এবং ফেসবুকের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালো করে যাচাই করে নিতে হবে। এ ছাড়াও কখনো এ ধরনের প্রতারকের খপ্পরে পড়লে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শও দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।