নিজস্ব প্রতিবেদকঢাকা
কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধ-ধোঁয়া এবং মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দের মধ্যে কোনো এলাকায় কারও পক্ষে বেশিক্ষণ টিকে থাকা কঠিন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বিএনপিও তাদের মহাসমাবেশ শেষ করতে পারেনি, মাঝপথেই তা পণ্ড হয়ে যায়। রাজধানীর নয়াপল্টনে গতকাল শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিএনপির এই মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আশপাশের অন্তত ছয়টি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়ান দলটির নেতা-কর্মীরা। রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে পুলিশের এক সদস্য ও যুবদলের ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতা নিহত হয়েছেন।
সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পুলিশের ৪১ ও আনসারের ২৫ সদস্য। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন সাংবাদিক। বিএনপির দাবি, সংঘর্ষে তাদের হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষের সময় অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেলসহ বেশ কটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশের হিসাবে, আগুন দেওয়া হয়েছে মোট ৫৫টি গাড়িতে। হামলা হয় কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে। এ ছাড়া কাকরাইল, ফকিরাপুল, নাইটিঙ্গেল মোড় ও শান্তিনগর এলাকার সাতটি পুলিশ বক্স পোড়ানো হয়। কমলাপুরে পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর কাকরাইল, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, সেগুনবাগিচা ও শান্তিনগর এলাকার বিভিন্ন সড়কে কখনো একটানা, কখনো থেমে থেমে এই সংঘর্ষ হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের পাশাপাশি রাবার বুলেটও ছুড়েছে পুলিশ। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পেটাতে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা-কর্মীও যোগ দেন। তাঁরা বিজয়নগর ও সেগুনবাগিচা এলাকার অলিগলিতে আশ্রয় নেওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের খুঁজে বের করে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
বিএনপির মহাসমাবেশস্থলে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল, মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমগুলোও ঘটনাস্থল থেকে খবর পাঠাতে সমস্যায় পড়ে। তবে উল্টো চিত্র ছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলে। বিএনপির মহাসমাবেশ চলার সময় সংঘর্ষের এক পর্যায়ে নয়াপল্টনে বিদ্যুৎ-সংযোগ চলে যায়, সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ ফিরে আসে।
হামলা, মামলা, বাধা, তল্লাশি ও গ্রেপ্তার মোকাবিলা করে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে গণসমাবেশ, পদযাত্রা, গণ-অনশনসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে আসছিল বিএনপি। রাজপথে অহিংস থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে সচেষ্ট ছিল দলটি। ঢাকার বাইরে দলটির বিভাগীয় গণসমাবেশে সরকারের দিক থেকে নানাভাবে বাধা এলেও সংঘাতের পথে যায়নি বিএনপি। সরকার পতনের চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে এসে গতকালের মহাসমাবেশে সেই অহিংস অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি দলটি। ইট-পাথর ছুড়ে মারার পাশাপাশি লাঠিসোঁটা নিয়েও পুলিশের ওপর হামলা চালাতে দেখা যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের। অবশ্য গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির দিনও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির দাবি, তাদের মহাসমাবেশে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে আজ রোববার দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী তাদের একজন সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় সরাসরি বিএনপিকে দায়ী করেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিএনপি পূর্বপরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, ‘যেসব পুলিশ সদস্য পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত, আহত হয়েছেন, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুষ্কর্ম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যাতে সংঘটিত হতে না পারে, সে জন্য সর্বশক্তি দিয়ে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে গেলেও জামায়াতে ইসলামী গতকাল রাজধানীর আরামবাগে পুলিশের অনুমতি না নিয়েই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। জামায়াত মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলেও ওই এলাকা সকাল থেকে ছিল পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। জামায়াতের নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বরের অদূরে আরামবাগে জড়ো হন। তাঁরা সেখানে সমাবেশ করে চলে যান। পুলিশ বাধা দেয়নি।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে নয়াপল্টন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের সামনে। সমাবেশে অংশ নেওয়া নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগের হাতে লাঠি ছিল।
প্রথম আলোর ১২ জন প্রতিবেদক ও ৪ জন আলোকচিত্রী গতকাল রাজপথে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও পুলিশের তৎপরতার খবর সংগ্রহ করার কাজে যুক্ত ছিলেন।
ঢাকায় নয়টি বাসসহ অর্ধশতাধিক যানবাহনে আগুন
সংঘর্ষের সূত্রপাত কাকরাইলে
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত গতকাল বেলা ১১টার পর কাকরাইলে। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের জমায়েত নয়াপল্টন থেকে নাইটিঙ্গেল, রাজমণি হোটেল পার হয়ে কাকরাইল মোড়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছায়। সেখানে থাকা পুলিশের সদস্যরা নেতা-কর্মীদের কাকরাইল মোড়ে অবস্থান না করার জন্য বলেন। কয়েকবার সতর্কও করেন। এ নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে পুলিশ ধাওয়া দেয়। তখন বিএনপির নেতারা-কর্মীরা পুলিশকে ইটপাটকেল ছোড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় কাকরাইল মোড়ে (মনসুর আলী সরণি) দুটি পিকআপ পৌঁছায়। পিকআপে থাকা লোকজন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা মারধরের শিকার হন। কিছুক্ষণ পর কাকরাইল মসজিদের সামনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আরেকটি বাস এসে পৌঁছায়। তখন সেখানে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাসে ভাঙচুর ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মারধর করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রগুলো বলছে, কাকরাইল মোড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মারধরের পর একপর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। তখন কয়েকজন বাড়ির ভেতরে লাঠি নিয়ে ঢুকে পড়েন ও হামলা চালান। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে ওই জায়গা থেকে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
বেলা পৌনে একটার দিকে আওয়ামী লীগের ব্যানার নিয়ে এক ব্যক্তি রিকশায় করে কাকরাইল মোড় অতিক্রম করার সময় তাঁকেও মারধর করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এরপর পুলিশের সঙ্গে বিএনপির পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে বিএনপির কর্মীরা কাকরাইল মোড় থেকে নয়াপল্টনের দিকে পিছু হটতে থাকেন। এ সময় কাকরাইল চার্চসংলগ্ন পুলিশ বক্স ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের ভেতরে দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বেলা দুইটার দিকে কাকরাইল মোড়ে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এর আগেই পুলিশের টানা কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডের মুখে বিএনপির কর্মীরা শান্তিনগর ও নয়াপল্টনের দিকে চলে যান।
হরতালের নামে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে কঠোর ব্যবস্থা: ডিএমপি কমিশনার
বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড
কাকরাইলে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল আধা কিলোমিটার দূরে নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশস্থল থেকেও। কাকরাইলের সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দও শোনা যাচ্ছিল সমাবেশস্থলে। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ সেখানেও পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যে পুলিশ কাকরাইল থেকে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে বিএনপির সমাবেশস্থলের দিকে আসতে থাকে। তখন ধোঁয়া ও বিকট শব্দের কারণে নয়াপল্টনের রাস্তায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে মঞ্চ থেকে নেতারা চলে যেতে বাধ্য হন। আর কর্মীরা চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকেন। বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে নয়াপল্টনের সমাবেশস্থল পুরো ফাঁকা হয়ে যায়। এলাকাটি চলে যায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে।
এর আগে বেলা দুইটার দিকে মহাসমাবেশস্থলের মঞ্চ থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘কারও উসকানিতে পা দেবেন না, দয়া করে বসে যান। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নস্যাৎ করতে চায় তারা (সরকার)।’
মির্জা ফখরুল যখন এ আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখন কাকরাইলের দিক থেকে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া আসছিল। তবে মহাসমাবেশের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি। এ সময় মঞ্চ থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দু-একটা পটকায় ভয় পাবেন না। গুলি হলে হবে।’
এরপর বিএনপির নেত্রী সেলিমা রহমান বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তাঁর বক্তব্যের শেষ দিকে এসে মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন বেলা আড়াইটা। এর আগে বক্তব্যে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ জনসভায় গোলাগুলি করছে তারা।
আমীর খসরুর বক্তব্যের সময়ও বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কাকরাইলের দিক থেকে এই শব্দ যখন আসছিল, তখন মহাসমাবেশস্থলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া মঞ্চের দিকে আসতে থাকে। বেলা পৌনে তিনটায় একটি ভ্যানে করে রক্তাক্ত এক ব্যক্তিকে মঞ্চের সামনে আনা হয়। তখন উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়।
মহাসমাবেশস্থল ছাড়ার সময় বেলা তিনটার দিকে রোববার (আজ) সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছোট ছেলে গ্রেপ্তার
সংঘর্ষ ছড়ায় আশপাশে
পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে টিকতে না পেরে নয়াপল্টনে সমাবেশস্থল থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে নেতা-কর্মীদের একটা অংশ শান্তিনগরের দিকে চলে যায়। সেখানে আগে থেকেই বিএনপির কর্মীদের জমায়েত ছিল। একপর্যায়ে সেখানেও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন শান্তিনগর মোড়ে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়, পোড়ানো হয় একটি মোটরসাইকেল। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা শাহজাহানপুর ও মালিবাগের দিকে চলে যান।
নয়াপল্টনের কাছে বিজয়নগরে পানির ট্যাংক এলাকায় ছিল ১২-দলীয় জোট ও গণ অধিকার পরিষদের সমাবেশ। কাকরাইলের ঘটনার জেরে এখানেও পুলিশের সঙ্গে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশও কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। একপর্যায়ে বিএনপি ও গণ অধিকার পরিষদের কর্মীরা পুরানা পল্টনের জামান টাওয়ারের দিকে চলে যান।
বিকেল পাঁচটার দিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ও ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে পুরানা পল্টন টাওয়ার এলাকা দখলে নেন। কিছুক্ষণ পর বিএনপি ও গণ অধিকারের কর্মীরা সংগঠিত হয়ে ধাওয়া দিলে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা পিছু হটে পানির ট্যাংকের মোড়ে অবস্থান নেন। দুপুর থেকে প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষে পুলিশ বিপুলসংখ্যক কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এ সময় বিজয়নগরে এবি পার্টির কার্যালয়েও হামলা হয়।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সেগুনবাগিচা এলাকায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকায় সংঘর্ষে নিহত পুলিশ কনস্টেবল আমিরুলের বাড়িতে মাতম
পুলিশের সদস্য নিহত
বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ফকিরাপুলের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় মো. আমিরুল ইসলাম পারভেজ (৩২) নামের পুলিশের এক কনস্টেবল মাথায় আঘাত পেয়ে রাস্তায় পড়ে যান। উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংঘর্ষে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছে ছবি আছে, ছাত্রদলের এক নেতা নৃশংসভাবে তাঁকে (পুলিশ সদস্য পারভেজ) পিটিয়েছেন। শুধু পেটাননি, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাঁর মাথা ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছে। ওই পুলিশ সদস্য ইন্তেকাল করেছেন। আমাদের পুলিশ বাহিনী অনেক ধৈর্যের সঙ্গে তাদের (বিএনপি) মোকাবিলা করেছে। তারা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়েছে। তাদের একটা ঘোষণা বা পরিকল্পনাই ছিল যে তারা একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।’
ওই পুলিশ সদস্যকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন ছাত্রদলের এক নেতা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ওয়ার্ড যুবদল নেতা নিহত
কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে ছুড়তে নয়াপল্টন এলাকায় পুলিশ পৌঁছার পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা এদিক-ওদিক ছুটতে থাকেন। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। সংঘর্ষে শামীম মিয়া নামের যুবদলের এক নেতা নিহত হন। তিনি রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা।
মুগদা থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি কাজী সুমন প্রথম আলোকে বলেন, শামীম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের ১ নম্বর ইউনিটের সভাপতি ছিলেন।
শামীমের মৃত্যুর খবর পেয়ে সন্ধ্যায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ছুটে আসেন তাঁর ছোট ভাই নূর মোহাম্মদ। তিনি সন্ধ্যা সাতটার দিকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শামীমের স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শামীম পেশায় প্রাইভেট কারের চালক ছিলেন। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না, তা তাঁর জানা নেই।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে আগুন
পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে গতকাল বেলা তিনটার দিকে রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইনস হাসপাতাল চত্বরে সাতটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি মাইক্রোবাস ও পাঁচটি মোটরসাইকেল। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে গাড়িতে আগুন দেন।
ঢাকায় ৭৮৩ জন গ্রেপ্তার
মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর নয়াপল্টন এলাকায় রায়ট কার (দাঙ্গা দমনে ব্যবহৃত গাড়ি) নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এ ছাড়া নিরাপত্তার জন্য ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, পুলিশের অনুমতির ভিত্তিতেই আইনসম্মতভাবে সমাবেশ করা হচ্ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা করে এই সমাবেশে বেআইনিভাবে হামলা চালানো হয়েছে।
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ৭৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে শুধু ডিএমপি এলাকায় বিএনপির ১ হাজার ১১৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির ‘মহাসমাবেশ’ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ সমাবেশকে ঘিরে কয়েক দিন ধরেই উত্তপ্ত ছিল দেশের রাজনীতি। একই দিনে দুই দলের পাল্টাপাল্টি এই কর্মসূচি ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিল। অনেক দিন পর আবার ঢাকার রাজপথে সংঘাত-সহিংসতায় রক্ত ঝরল। সামনের দিনগুলোতে কী ঘটবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গতকালের এই সহিংসতা।