ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গত ১১ বছরে মশকনিধনে ব্যয় করেছে এক হাজার ৮০ কোটি টাকা। তার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন খরচ করেছে ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। তা ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ১১ বছরে মশক নিধনে ব্যয় করেছে ৪৯২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গতকাল সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণায় এমনটিই উঠে আসে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মশকনিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ডিএনসিসি। সংস্থাটির এই খাতে বছরে হোল্ডিং প্রতি বাজেট দুই হাজার ২৩৬ টাকা। তবে ডিএসসিসির হোল্ডিং প্রতি এই বাজেট এক হাজার ১২৮ টাকা।
টিআইবির গবেষণায় আরও উঠে আসে, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ব্রাজিল ছাড়া বাকি সব দেশের প্রায় সমপর্যায়ে রয়েছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা ও হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ডেঙ্গুর পরিস্থিতি এতটা অবনতি হলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ ভুল তথ্য দিয়েছে। মশকনিধনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের ওপর দায়ভার চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার মধ্যে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল নারী। নারীদের মধ্যে বিলম্বে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা এই অধিক মৃত্যুর কারণ। চলমান পরিস্থিতির উন্নয়নে ২১টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, কীটনাশক ক্রয়ে ওপেন টেন্ডারিং ও সরাসরি ক্রয়প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-জিপি) মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিংয়ের কিছু ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গেল বিডিং’ লক্ষ করা গেছে। একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়, যার মধ্যে সাতটিতে তারা একক বিডার ছিল। কীটনাশক ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাধরণত নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বিদ্যমান ছিল। তা ছাড়া এ সব প্রতিষ্ঠানের নামে নিম্নমানের কীটনাশক সরবরাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করা নিবন্ধনবিহীন কীটনাশক যথাযথভাবে পরীক্ষা না করেই মশকনিধন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কিছু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে কীটনাশক আমদানির অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করা নিবন্ধনবিহীন কীটনাশক যথাযথভাবে পরীক্ষা না করেই মশকনিধন কার্যক্রমে ব্যবহার করছে। এতে করে মশকনিধনে সুফল মিলছে না। ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধে রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রমে এড়িয়ে চলেছে মাঝে মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ না করেই কাজ করছে সবাই। তা ছাড়া বাংলাদেশের করোনা সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সমন্বয়হীনভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাঠকর্মীদের ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে ‘অধিক কার্যকর’ ওষুধ স্প্রে করে আসার অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর ১০০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০২৩ সালে এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ মতে, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকার প্রদত্ত সংখ্যার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু রোগটি ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। সেটি সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এটি এখন আর মৌসুমভিত্তিক নেই। এর জন্য প্রতি বছরই বাজেট থাকে তবে কার্যক্রমে থাকে না। যেটুকু বরাদ্দ ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি; বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা লোকদেখানো কার্যক্রম পরিচলানা করা হয়েছে। মশা মারার যন্ত্রপাতির জন্য জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়েছে। এডিশ মশা নিধনহীনের দায় জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও জনগণ কিছুটা অসচেতন ছিল তবে জনগণ নিয়ম মানার জন্য পরিবেশ সরকার তৈরি করতে পারেনি।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, আমরা করোনার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রকোপ বেড়ে গেলে গবেষণা করে সরকারকে কিছু পরামর্শ দেই। আশা ছিল নীতিকাঠামো ও নৈতিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু দেখা গেছে, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি দেশি ও বৈশ্বিক উভয় মাপকাঠিতেই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অস্বীকার করা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে।