বিশেষ প্রতিনিধিঢাকা
দলের মহাসচিব কারাগারে, পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে অনেক নেতা আত্মগোপনে—এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টানা তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে আজ মঙ্গলবার মাঠে নামছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলেছেন, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, এখন তাঁরা টানা কর্মসূচিতে থাকতে চাইছেন।
আজ ভোর থেকে ২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সারা দেশে মহাসড়ক, রেল ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্য দল ও জোটগুলো বিএনপির অবরোধ কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে। আজ থেকে টানা তিন দিনের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও।
আজ ভোর থেকে ২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সারা দেশে মহাসড়ক, রেল ও নৌপথে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি অহিংস ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর হামলা ও সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকায় দলের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার ঘটনাকে একটা ধাক্কা হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতাদের অনেকে।
মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি বিএনপির
দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, ২৮ অক্টোবর সহিংসতার জেরে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান, নতুন মামলা ও সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপিকে। তবে আন্দোলনে যাতে ছেদ না পড়ে এবং আন্দোলনকে আরও গতি দেওয়ার বিবেচনা থেকে দীর্ঘ সময় পর বিএনপি এবার হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছে।
২৮ অক্টোবর হামলা ও সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকায় দলের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার ঘটনাকে একটা ধাক্কা হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতাদের অনেকে।
মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিনই ২৯ অক্টোবর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। এরপর এক দিন বিরতি দিয়ে আজ থেকে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে নামছে দলটি। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকারের দমনপীড়নের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কর্মসূচি পালন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এরপরও আজ সারা দেশে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করবেন তাঁরা।
আবার সংঘর্ষ, আবার মৃত্যু
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে দলের শীর্ষ পর্যায়ের অন্য নেতারা আত্মগোপনে গেছেন। তাঁদের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনের কর্মসূচির সমন্বয় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, এমন চিন্তা মাথায় রেখেই আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপের নেতৃত্ব ও সমন্বয়কারী এবং কর্মসূচিসহ সার্বিক বিষয়ে তাঁরা পরিকল্পনা করে রেখেছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অজ্ঞাত স্থান থেকে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করেন।
পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকারের দমনপীড়নের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কর্মসূচি পালন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী
‘তৃণমূলে হতাশা সৃষ্টি হয়নি’
সারা দেশেই মামলা হচ্ছে এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির নেতাদের অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি দলের প্রায় সব পর্যায়ের নেতাদের আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। এতে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও আন্দোলনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি বিএনপির তৃণমূলে কোনো হতাশা সৃষ্টি করেনি; বরং প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই টানা কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূলও মাঠে থাকতে চাইছে বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায় পুলিশের অভিযান
দেশের অন্তত ১২টি জেলায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। জেলাগুলো হলো: বগুড়া, রাজশাহী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল, টাঙ্গাইল ও কুষ্টিয়া। এসব জেলার বিএনপি নেতারা বলেছেন, গত কয়েক দিনের পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন; কিন্তু হতাশা নেই। মামলা, গ্রেপ্তার অভিযানের মুখেও আন্দোলনের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে তাঁরা এবার এর পরিণতি দেখতে চান। কারণ, তাঁদের এখন পিছু হটার সুযোগ নেই।
জামালপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ওয়ারেছ আলী (মামুন) প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাপলা চত্বরে হেফাজতের ওপর যে ঘটনা ঘটিয়েছিল সরকার, ২৮ অক্টোবর বিএনপির ওপরও সরকার পরিকল্পিতভাবে একই ঘটনা ঘটিয়েছে। বিএনপির যে সংগ্রাম, বিএনপি সেটি চালিয়ে যাবে, আমরা তা বিশ্বাস করি।’
বিএনপি নেতারা বলেছেন, গত কয়েক দিনের পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন; কিন্তু হতাশা নেই।
‘পিছু হটার সুযোগ নেই’
১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনে বিএনপির কেন্দ্র থেকে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা মামলার বোঝা বইছেন। তাঁদের বড় অংশ বছরের পর বছর এলাকায় থাকতে পারেননি। তাঁরা এবার আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল কারাগারে
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটের বাইরে অন্য দলগুলোকেও এক জায়গায় আনতে পেরেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে এবার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও তৎপর হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এ ছাড়া দলটি মনে করছে, এবার সরকার যদি একতরফা নির্বাচন করে ফেলতে পারে, তাহলে বিএনপি দল হিসেবেই অস্তিত্বসংকটে পড়বে। সে কারণে এ পর্যায়ে কঠোর কর্মসূচি নেওয়া ছাড়া বিএনপির পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই এবং এ মুহূর্তে দলটি বিকল্প কিছু চিন্তা করছে না। এখন টানা কর্মসূচি নিয়েই মাঠে থাকবে বিএনপি।
জামায়াতও অবরোধে নামছে
২৮ অক্টোবর অনুমতি না পেলেও জামায়াতে ইসলামী ঢাকায় সমাবেশ করেছে। সেদিন অল্প দূরত্বেই বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হলেও বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে নির্বিঘ্নে জামায়াত সমাবেশ করেছে। এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে বিএনপির কর্মসূচির দিনে জামায়াতও আজ থেকে তিন দিনের অবরোধের ডাক দিয়েছে।
জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতেই জামায়াত অবরোধের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত থাকার চেষ্টা করবে। জামায়াতের সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, দীর্ঘ সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু মাস দুয়েক ধরে দুই দলের শীতল সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
অবরোধের প্রস্তুতি
আজ ভোর থেকে তিন দিন বিএনপি রাজধানী ঢাকাকে দেশের অন্য সব জেলা থেকে এবং জেলা শহরগুলোকে অন্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। সে লক্ষ্যে দলটির নেতা-কর্মীরা ঢাকাকে ঘিরে মহাসড়কগুলোতে এবং জেলা উপজেলার মহাসড়কে, রেলপথ ও নৌপথে অবস্থান নিয়ে অবরোধ সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছেন। তবে সংবাদপত্র বহনকারী যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ এবং অক্সিজেন বহনকারী যানবাহন অবরোধের আওতার বাইরে থাকবে।