নিয়ম-নীতি অমান্য করে নির্ধারিত হারের অধিক চাঁদা আদায় চলছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তত ২৫ পয়েন্টে। যা পুরোপুরি ডিএসসিসির শর্তের বিপরীত। বাড়তি এই টাকা কেউ দিতে না চাইলে চালানো হয় নির্যাতন। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ফেলা হয় গাড়ির ক্লাস। করা হয় মারধর, দুর্ব্যবহার। আর পুলিশের সামনেই চলছে এসব কর্মকাণ্ড। ভুক্তভোগীদের দাবি— এটা রীতিমতো চাঁদাবাজি, দেখার কেউ নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলা এসব চাঁদাবাজরা কিছুটা সহনশীল হলেও রাত হলেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তারা। বিভিন্ন পরিবহনের ড্রাইভার-হেলপারদের কাছে মূর্তমান আতঙ্ক এসব টোল আদায়কারী গ্রুপ। গত এক সপ্তাহ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র চোখে পড়ে।
কাপ্তান বাজার থেকে পণ্য নিজের দোকানে খুচরা বিক্রি করেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। ফুলবাড়িয়া মোড়ে টোলবাজদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে দেখা যায় তাকে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজের মাল নিজেই বহন করে এনেছি। এরপরও কুলি খরচ হিসাবে আমার কাছ থেকে তারা ১০০ টাকা দাবি করেছে। টাকা না দিতে চাওয়ায় বাধে বিপত্তি। এরপর ১০০ টাকা দিয়ে মেলে নিস্তার। রাজধানীর বাবু বাজার ব্রিজের গোড়ায় জাহাঙ্গীর নামে সিটি কর্পোরেশনের এক ময়লার গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি একটা বস্তায় ভরা ময়লা নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে না চিনে তারা আমার কাছ থেকে প্রথমে ১০০ টাকা টোল দাবি করে। আমি টাকা না দিয়ে তাদের বলি- আমার বস্তাটা নিয়ে যান। টাকা নাই। এরপর তারা বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দেয়। এরকম চিত্র পাইকারি বিপণিবিতান ও মার্কেট-নির্ভর ঢাকা দক্ষিণের গোটা এলাকার। খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে যাওয়ার সময় তাদের ওপর নিষ্ঠুর দৃষ্টি পড়ে টোল আদায়কারী লাঠিয়াল বাহিনীর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দক্ষিণ সিটি এলাকায় প্রতিরাতে কয়েক হাজার পণ্যবাহী গাড়ি চলে। এসব গাড়ির মধ্যে যেগুলো বাবুবাজার ব্রিজ বা পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যায়, গাড়িপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা টোলের নামে চাঁদা দিতে হয় তাদের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢুকতে দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, সায়েদাবাদ ও শনির আখড়ায় এই চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন চালকরা। দিনের বেলা এসব চাঁদাবাজি কিছুটা সহনীয় মাত্রায় থাকলেও রাত যত গভীর হয় ততই বাড়তে থাকে এসব টোলবাজদের অত্যাচার। অনেক সময় এসব টোল আদায়ের কারণে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট।
পুরান ঢাকার বংশালের সুরিটোলা ওভারব্রিজের উপর, বংশাল থানাধীন গুলিস্তান-নয়াবাজার সড়ক, বাবু বাজার ব্রিজের গোড়ায়, কদমতলী, কাপ্তান বাজার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামতে গুলিস্তান মোড়, মতিঝিল, কমলাপুর, জুরাইন, পোস্তগোলা, দোলাইরপাড়, রায়েরবাগ, শনির আখড়া, ডেমড়া স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল মেডিকেল, মুগদা, খিলগাঁও, কমলাপুর, গোলাপবাগ মোড়, কোনাপাড়াসহ দক্ষিণ সিটির প্রায় ২৫টি স্পটে চলে এসব টোলবাজদের টোলের নামে চাঁদা আদায়। রাতে এসব টোলবাজরা সড়কে লেজার লাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পণ্যবাহী চলন্ত ট্রাক আর কাভার্ডভ্যান দেখলেই লেজার লাইটের রঙিন আলো নিক্ষেপ করেন তারা। আবার কখনো লাঠির ইশারা দিয়ে থামান গাড়ি। এরপর ছোট্ট একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে আদায় করেন টাকা। কেউ টাকা দিতে না চাইলে লাঠির আঘাত শুরু হয় গাড়ির সামনের গ্লাসে, বডিতে। পেটানো হয় চালকদের, হুমকি দেয়া হয় গাড়ি গায়েবের। শুধু পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানই নয়, এই টোলবাজদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সাধারণ যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস থেকে শুরু করে প্রাইভেটকারও। যদিও টাকা নেয়া এসব যুবকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। দিতে চাননি কোনো ধরনের তথ্য। কোনো ধরনের তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে বলেও জানান। এমনকি নাম পর্যন্ত বলতে রাজি নয় তারা। তবে তাদের দাবি তারা সিটি কর্পোরেশনের লোক। বৈধভাবেই সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমোদন নিয়েই তারা টাকা আদায় করছেন। অথচ আমার সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সড়কে টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকা এসব যুবকদের অধিকাংশই চুক্তিভিত্তিক। তাদের প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি দেয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে সেভেন-এলিভেন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আফতাব উদ্দিন। চার কোটি টাকা এবং এর ৩০ শতাংশ ভ্যাট অর্থাৎ পাঁচ কোটি ২০ লাখ টাকায় টোল আদায়ের ইজারা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর পেছনে আরও কয়েকজন অর্থ লগ্নি করেছে বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি টোল আদায়ের জন্য এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন প্রভাবশালীদের সাব-ইজারা দিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই প্রভাবশালীদের কেউ যুবলীগ আবার কেউ যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক মাঠে বিরোধ থাকলেও মিলেমিশে চাঁদাবাজি করেন তারা— এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। জানা গেছে, গুলিস্তান এবং কাপ্তান বাজার এলাকায় টোলের সমন্বয় করেন নিয়াজ মোর্শেদ জুম্মন ও হাজী মো. শাহাবুদ্দিন নামের দুই ব্যক্তি। জুম্মন ৩৪ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি এবং শাহাবুদ্দিন ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে শাহাবুদ্দিনকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর তাদের হয়ে ওই এলাকায় টোল আদায়ের দায়িত্ব পালন করেন আরও শতাধিক লাঠিয়াল বাহিনী। তারা টাকা তুললেও এই টাকার ভাগ ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নেতাকর্মীদের পকেটে যায়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে গত ১৭ অক্টোবর দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির গুলশানের কার্যালয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আফতাব উদ্দিনকে পাওয়া যায়নি। এরপর অফিস থেকে তার নম্বর নিয়ে ফোন দিলে তিনি বাইরে আছেন বলে জানান। কখন ফিরবেন সেটা জানতে চাইলে বলেন, ‘লেট হবে।’ এরপর মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি সব ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, ‘তারা নিয়ম মেনেই টোল আদায় করছেন। সাব কন্ট্রাকের বিষয়ে তিনি বলেন, সাব-কন্ট্রাক নয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এটা আমাদের আন্ডারেই আছে। আমাদের লোকজনই উঠায়। কাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবু নামের একজন আছে। আর একজন হলো মনির। ও গুলিস্তান এলাকায় উঠায়। জুম্মন নামের কেউ দায়িত্বে আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই যে মনির আছে। মনিরের সাথে থাকতে পারে আর কি। আপনি চিনেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, চিনি। যুবদল ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে আপনি টাকা উঠাচ্ছেন কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, এমন কোনো লোক নাই। সবাই আমাদের দলের। আওয়ামী লীগের। বিভিন্ন পরিবহনের হেলপার ড্রাইভারদের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, খারাপ আচরণ কেন করবে? অতিরিক্ত টাকা না দিলে খারাপ আচরণ করা হয় জানালে তিনি বলেন, আমরা অতিরিক্ত টাকা নেই না।’
এরপর তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা আসলে যারা বৈধ ইজারাদার, যারা সরকারকে টাকা দিয়ে নিচ্ছে তাদেরকেই খুঁজতেছেন। অবৈধভাবে যারা টাকা উত্তোলন করে তাদের বিষয়ে আপনারা কথা বলেন। এখানে রাত হইলে, দিনের বেলা বিভিন্ন নামে বেনামে টাকা উঠায়। এখন কে কোথা থেকে টাকা উঠায় সেটা তো আর আমি জানি না। বিভিন্নভাবে নামে-বেনামে অনেক লোক চাঁদা তোলে। যেমন ট্রাকচালক মালিক সমিতি, ঢাকা জেলা। এখন এ গুলোর দায়ভার তো আর আমরা নেব না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছে। কোথা থেকে ইজারাদাররা টোল আদায় করতে পারবেন, কোন কোন পরিবহন থেকে টোল নেয়া যাবে, কুলির খরচ কত, তাও ইজারাদারদের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এই চুক্তিপত্রে একটি কপি এসেছে আমার সংবাদের হাতে। সেই চুক্তিপত্রে সিটি কর্পোরেশন এবং টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি শর্ত রয়েছে। টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে এসব শর্ত মেনে টোল আদায় করতে হবে।
সেখানে দেখা যায়, ৬ নম্বর শর্তে রয়েছে নির্ধারিত হারের অধিক ফি আদায় করা যাবে না, ১৩ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে যাত্রী সাধারণ, গাড়ির ড্রাইভার ও মালিক-শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার করা যাবে না, ১৮ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে কোনো যাত্রী সামান্য মালামাল উঠানো বা নামানোর জন্য কুলিদের সাহায্য না চাইলে কোনো কুলি ওই মালামাল স্পর্শ করা বা অর্থ দাবি করতে পারবে না, ২৩ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ইজারাদার সিটি কর্পোরেশনের এসব শর্ত মানতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু এর কিছুই মানছে না ইজারাদারদের নিয়োগ করা টোলবাজরা। পুলিশের সঙ্গে সখ্য করে রাজনৈতিক নেতাদের মদতে এই অত্যাচার চলছে দিনের পর দিন। এছাড়াও চলন্ত গাড়ি থামিয়ে টোল আদায় করা যাবে ২৪টি শর্তের কোথাও এটি উল্লেখ নেই। চুক্তিতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের নাম উল্লেখ করে টোল আদায়ের কথা বলা হলেও পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানের কথা বলা নেই। বলা হয়েছে, নির্ধারিত রুট ও স্থান ছাড়া রাজস্ব আদায় করা যাবে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা ও পিকআপ থেকে ৩০ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও এসব বাহন থেকে নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা ও ১০০ টাকা করে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) হায়দার আলীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তিনি সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। সেভেন-এলিভেন গ্রুপ নামের একটা প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের ইজারার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হতে পারে।’ এরপর বিস্তারিত অভিযোগ বললে সব শুনে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।