বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে পর্দার অন্তরালে দেশী বিদেশী বিভিন্ন মহলের দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্বাচন ইস্যুতে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এদিকে বিএনপির লাগাতার আন্দোলনের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশে জনদুর্ভোগ বেড়েছে।
২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ সফল করে আন্দোলনের শেষ ধাপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল বিএনপি। ওই দিনই রাজনৈতিক শক্তির মহড়া দিয়ে কঠোর লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল দলটি। কিন্তু কর্মসূচি শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ায় বিএনপির মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। এ কারণে দলটির আন্দোলনে নতুন মোড় নেয়। এ কারণে পরদিন ২৯ অক্টোবর দেশব্যাপী হরতাল পালন করে। এর পর প্রথম ধাপে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন শেষে দ্বিতীয় ধাপে রবিবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর ১ দিন হরতাল ও ৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সারাদেশে ৩১টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বাংলাদেশ-ভারত মেত্রী ট্রেনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কারণে দেশ-বিদেশে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিকে রাজপথের আন্দোলন থেকে নির্বাচনমুখী করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। কিভাবে সরকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দল বিএনপির সমঝোতা করা যায় এ নিয়ে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুই দলের অবস্থান দুই মেরুতে হওয়ায় এখন পর্যন্ত সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠ দখলে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। এ জন্য তারাও বিএনপিকে রাজনৈতিকভবে মোকাবিলা করতে ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার পরও বিএনপির ডাকা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজপথে ছিল সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ছিল তৎপর। কিন্তু বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ২ মাস বাকি। কিন্তু বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে হলে সংসদে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের সমর্থনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু ২ নভেম্বর বর্তমান জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাই এখন সরকার রাজি থাকলেও বিএনপির দাবি অনুসারে নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা আইনগতভাবে করা যাবে না। আর এ কথা চিন্তা করেই ৩ দিনের অবরোধ শেষে বিএনপি আবারও ২ দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এভাবে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে তারা রাজপথ দখলের চেষ্টা করছে। আর আওয়ামী লীগও নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজপথে থাকার কৌশল গ্রহণ করেছে।
উল্লেখ্য, ১৮ অক্টোবর পল্টনের সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। ওইদিনই বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগও ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করর ঘোষণা দেয়। ২৮ অক্টোবর দুই দলই সারাদেশের সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে ঢাকায় জড়ো করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বিএনপি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সমাবেশ সফল করতে না পারলেও আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলে।
গত বছর ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ ও রোডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শেষে ১৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ডাক দেয়। আওয়ামী লীগও দেশব্যাপী দলের সর্বস্তরে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ শেষে ১৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোরই রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। একই দিনে এক কিলোমিটার দূরত্বে দুই দলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে জনমনে টানটান উত্তেজনা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের পর বিএনপি রাজপথে কঠোর কর্মসূচি শুরু করায় জনমনে আশঙ্কা আরও বাড়ে।
প্রায় দেড় যুগ বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল নেয় বিএনপি। দলীয় হাইকমান্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি হয়ে থাকা বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী গতবছর জুলাই মাস থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ধারাবাহিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় হতে থাকে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির দাবি অনুসারে ইতোমধ্যেই ২২ জন মারা গেছে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আর মামলা-হামলার শিকার হয়েছে আরও অনেকে। তারপরও আগের চেয়ে কিছুটা সাহসী হয় দলটির নেতাকর্মীরা। তবে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সহিংসতার অভিযোগে দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় বিএনপি এখন কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকবিলা করতে আওয়ামী লীগও পল্টা কর্মসূচি দিয়ে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটিয়ে রাজপথ দখলে রেখেছে। সেইসঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করে উন্নয়নের চিত্র দেশবাসীর কাছে তুলে ধরে এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় আবারও ভোট প্রার্থনা করছে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল আগের চেয়ে চাঙ্গা হয়েছে। এ বিষয়টি বিএনপির রাজনীতির জন্য নেতিবাচক বার্তা বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির চলমান আন্দোলন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, বিএনপি সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তারা ঘুরেফিরে তাদের পুরনো নাশকতা, সন্ত্রাসের ধারায় ফিরে এসেছে। আন্দোলনের নামে সহিংসতা করে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতিতে বলেন, অবরোধে ভয় পেয়ে আওলীগ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ করতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এভাবে দলের নেতৃত্বকে দুর্বল করা যাবে না। তিনি অবিলম্বে নেতাকর্মীদের মুক্তি ও এক দফা মেনে নেয়ার দাবি জানান। এছাড়া বিএনপিকে আন্দোলন করার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে বাধা না দেয়ার আহ্বান জানান।