কবির হোসেন:
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বিরোধীতার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচত অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে ক্ষমতাসিন আওয়ামী লীগসহ বেশ কিছু দল মনোনয়ন বিক্রি করছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নানা নাটকীয়তার পর মনোনয়ন বিক্রি শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছুটা নির্বাচনী আমেজও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিদেশিদের তৎপরতাও অনেকটা কমে এসেছে।
দিন যতোই যাচ্ছে পরিবেশ আরও বেশি ঘোলাটে হচ্ছে বলে মনে করছেন সরকার বিরোধীরা। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ বিশ্বকে স্বচ্ছ নির্বাচন দেখিয়ে চতুর্থবার ক্ষমতায় আসতে চায়। এ জন্য তারা সব ধরনের চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
রাজনীতির মাঠে বিএনপি না এলেও নির্বাচন যথা সময়ে হবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, কেউ নির্বাচনে না এলে সরকারের কাজ নয় তাদেরকে ডেকে ডেকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সেটি তাদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তবে নির্বাচন প্রতিহত করার কথা বলে জনজীবনে অশান্তি, রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, গাড়ি পোড়ানো-এগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের কাজ নয়, এগুলো দুষ্কৃতকারীদের কাজ। আর যারা এভাবে গাড়িতে আগুন দেয় এবং নেতাদের কাছে সেই ভিডিও পাঠায়, আর নেতারা বলে, আগুন দিলে প্রমোশন হবে, তাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে বিএনপির অংশগ্রহণ আবশ্যক নয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রত্যাশা করছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই ভোটে আসার সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিশ্বাস, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবক্ষেণ করবে কমনওয়েলথ। যদিও চলমান সফরের প্রেক্ষিতে প্রাক-নির্বাচন দল যে প্রতিবেদন দেবে, তার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কমনওয়েলথ।
গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো লাগাতার হরতাল অবরোধের মতো কঠিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে তাদের এই কর্মসুচিকে রাজনৈতিক নয়, সন্ত্রাসী কর্মসূচি দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বিএনপি হরতাল অবরোধের নামে যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগুলো দমন করবে। বিএনপির এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম যদি আরও বেড়ে যায় তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগও দমন করবে।
জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পাটি নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে মনোনয় বিক্রি করলেও দলটির নেতারা বলছেন নির্বাচনের পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। দলটির মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করে, নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতার পালাবদল সম্ভব নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুক‚ল নয়। আমরা সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চেয়েছি, নির্বাচনের জন্য আস্থার শতভাগ পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি।
তিনি বলেন, গত ৩৩ বছরে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচন নিয়েই কথা আছে। এমনকি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনে যারা জিতেছে, তারা বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আর যারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি, তারা বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, বিএনপির নির্বাচন বর্জন করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অতীতেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা আসেনি। না আসার ফলে নির্বাচন একতরফা হয়েছে। এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে যদিও তারা যোগ দিয়েছিল কিন্তু তারা নির্বাচনী প্রচারণায় নামেনি। বরঞ্চ নির্বাচনটা খেলার ছলে নিয়েছিল। যার ফলে তারা খুব কমসংখ্যক আসন পেয়েছিল। এখন তারা যে অভিযোগ নিয়ে আসছে মূলত তারা নিজেরাই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়নি। এবং নির্বাচনকে নিয়ে কিছুটা প্রহসনে পরিণত করেছিল। নির্বাচন বাণিজ্য করেছিল। আমি মনে করি এবার যদি তারা নির্বাচনে না আসে সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এবং এ দল থাকবে কি না সেটাও একটা সন্দেহের বিষয়।
বন্দুকের জোরে নির্বাচন করলে সংকট আরো ঘনীভ‚ত হবে বলে মনে করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (বীর বিক্রম)। তিনি বলেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া, নিশিরাতে বা বন্দুকের জোরে নির্বাচন করা হলে, তা বর্তমান সংকটকে আরো ঘনীভ‚ত করবে। দেশের জনগণকে জিম্মি করে দেশে কি শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে? ইতিহাস তা স্বাক্ষী দেয় না। দেশের সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার, ও সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অর্থনীতি ও গরিব মেহনতি মানুষের সমস্যা গুলো বিবেচনায় নিন। দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে নির্বাচন পেছানোর ঘোষণাও দিয়েছে। বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলে পুনঃ তফসিল দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে ফরমালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) ভোটে আসার কথা জানাতে হবে।
রাশেদা সুলাতানা বলেন, সংকট সৃষ্টি হওয়ার আগেই যদি ওনারা আসেন, কাজেই এখনই কিছু বলব না। অতীতে যেভাবে হয়েছে, আমরা দেখব। যদি বাড়ানো প্রয়োজন হয়, বাড়াব। যদি বাড়ানোর মধ্যে না হয়ে এমনিই হয়, তাহলে হবে। কোনো অসুবিধা নেই। যদি এই তফসিলের মধ্যেই আসেন, তাহলে তো তফসিলে হাত দেওয়ার দরকার নেই।
তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পেছানোর বক্তব্যকে দেশের জনগণের সামনে মুলা ঝোলানো বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। আবদুল মঈন খান বলেন, আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৮ অক্টোবর বিরোধীদলের ওপর ক্র্যাকডাউনের পর থেকে সরকার যে মামলা-হামলা ও গ্রেফতার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করে আমাদের সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দিয়ে সবার আগে সরকার একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করুক। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। আজ তিন সপ্তাহের বেশি অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বিএনপি মহাসচিবের বেইল পিটিশনের শুনানি পেছানোর সিদ্ধান্তে সরকার পুনরায় প্রমাণ করেছে যে এ সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও রীতিনীতির ন্যূনতম অনুশীলন আশা করা যায় না। এমতাবস্থায় বিরোধী দলকে নির্বাচনে যোগ দেওয়ার শর্তে নির্বাচনী সিডিউল পিছিয়ে দেওয়ার মুলা ঝুলোনোর আহŸানের ওপরে দেশের মানুষ কীভাবে আস্থা থাকতে পারে সেটাই আজ দেশবাসীর জিজ্ঞাসা।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা কথাকে চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী বিএনপিকে দুর্বল ও রাজনীতিবিমুখ করার যে চক্রান্ত করছে। তবে সরকারের চক্রান্ত সফল হবে না। বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী তাদের গৃহপালিত কিছু রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। আবারো যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এটি তাদের সুপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যান। তবে এবার ২০১৪ এবং ২০১৮ এর মতো নির্বাচন করতে দিবে না দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ। জনগণ সম্মিলিতভাবে সরকারের সকল দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করতে বদ্ধপরিকর। নির্যাতন-নিপীড়ণের মাত্রা যত বাড়বে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মী ও জনগণ আরো বলীয়ান হয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেই ঘরে ফিরবে।