অ্যান্টিবায়োটিক বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

অ্যান্টিবায়োটিক বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন ইমরান হোসেন। গত সপ্তাহে তিনি ছয় দিন জ্বরে ভোগেন। জ্বরের চিকিৎসা হিসেবে তিনি গলির ফার্মেসি থেকে সাধারণ জ্বরের ওষুধ কিনে খেয়েছিলেন। কিন্তু জ্বর না কমায় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেলে ডাক্তার তাকে পাঁচ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল খেতে বলেন। কিন্তু তিন দিন ওই ক্যাপসুল খাওয়ার পর তিনি সুস্থ হয়ে যান। বাকি দুদিন আর অ্যান্টিবায়োটিক খাননি। অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পন্ন না করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে তিনি জানেন না কিছুই।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে আবেদীন হোসেন তার ১৪ বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তারের কাছে। তার ছেলে জ্বর-কাশিতে ভুগছে গত চার দিন ধরে। বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানোর পর প্রেসক্রিপশন হাতে তিনি দেখছেন তার ছেলের জন্য ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন কি-না। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশনে না লেখায় তিনি কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হন। তার ধারণা, অ্যান্টিবায়োটিক খেলে তার ছেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে কর্মরত ডা. সাজ্জাদুল হাসান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে রোগীদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। অনেক রোগী এসেই বলেন, আমাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিন। আমি অনেক ওষুধ খেয়েছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমরা রোগীর এই ভুল ধারণা ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করি। অ্যান্টিবায়োটিক যার প্রয়োজন, তাকেই দেয়ার চেষ্টা করি। কারণ, অ্যান্টিবায়োটিক কোনো সাধারণ ওষুধ নয়। এর কার্যকারিতা সঠিকভাবে না হলে রোগীর অবস্থা জটিল হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের গবেষণা বলছে, বাজারজাতকৃত অ্যান্টিবায়োটিক মধ্যে ১১টি সর্বাধিক ব্যবহূত। এর মধ্যে পাঁচটি জীবাণু কর্তৃক প্রতিরোধী, যাকে বলা হয় রেজিস্ট্যান্স। এই জীবাণু প্রতিরোধীর কারণে রোগীদের মধ্যে ৩৪ ভাগ ভালো হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭২ ভাগ ভালো হয় না। কারণ শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকরের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন অ্যান্টিবায়োটিকটি প্রয়োজন, সেটিও বিবেচনা করা হচ্ছে না। এতে জীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। আবার রোগীরা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবনও করছেন না। দুই থেকে তিন দিন খাওয়ার পর শরীর ভালো অনুভব করলে আর অ্যান্টিবায়োটিক খান না। তখন শরীরে জীবাণু থেকে যায়। পরবর্তীতে আবার অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও তখন আর কাজ না। এক শ্রেণির রোগী অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি বলে কিছুদিন খেয়েই কোর্স সমাপ্ত না করেই বন্ধ করে দেন।

গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে দিয়েছেন ৫০০ এমজি অ্যান্টিবায়োটিক; কিন্তু ওষুধে আছে ২০০ বা ১০০ এমজি। এতে জীবাণু ভয়ঙ্কর প্রতিরোধী হয়ে গেছে। আবার হাঁস-মুরগি-গরুসহ বিভিন্ন পশুর খামামি ব্যবহার করছেন মানুষের জন্য ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক। পশুদের জন্য এনিমেল অ্যান্টিবায়োটিক আছে; কিন্তু তা বেশিরভাগ খামারি ব্যবহার করেন না। তারা মানুষের জন্য ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করায় এসব হাঁস-মুরগি-মাছ, গরুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে স্বল্পপরিসরে প্রবেশ করে। কারণ এটা রান্নায়ও নষ্ট হয় না, পানিতে ধুলেও থেকে যায়। মানুষ যখন অসুস্থ হয়, তখন ওই অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কোনো কাজ হয় না। কারণ জীবাণু আগে থেকেই সেই অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে গেছে। তাই কাজ হয় না। এসব কারণে জীবাণু ভয়ঙ্কর প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, যা হতে পারে মৃত্যুর কারণও। সাম্প্রতিক সময়ে খামারে ৩৪টি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। এর অপব্যবহারে যদি শাস্তিমূলকসহ কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে আগামী এক যুগের মধ্যে অসংক্রামণ ব্যাধিতে যেসংখ্যক মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিকে মারা যাবে আরও কয়েকগুণ বেশি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়েছেন।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ও বাজারজাত নিয়ে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নূরুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে মারা যায়। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের ড্রাগস ও কসমেটিকস আইন-২০২৩-এ একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। যেখানে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কেউ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে তার ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষের ব্যবহূত অ্যান্টিবায়োটিক খামারে ব্যবহার প্রতিরোধ সম্পর্কে তিনি বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় খামারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়টি তদারকি করে। আমাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি

শীর্ষ সংবাদ স্বাস্থ্য