সরকার সব সময়ই বলে আসছে তারা একটি সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয় ইউনিয়নও চাচ্ছে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত হোক। অর্থাৎ জনগণ অবাধ এবং নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুষ্ঠু পরিবেশ থাকুক এটা চায় পুরো বিশ্ব। ছুটিতে যাওয়ার আগে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে অংশগ্রহণমূলক ভোট আয়োজনের তাগিদ দিয়েছিলেন। ওই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সব দলকে শর্তহীন সংলাপেরও আহ্বান জানান। কিন্তু শর্তহীন সংলাপে সম্মতি দেয়নি কেউ। শেষ সময়ে এসে সংলাপ করার সময় নেই বলেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।
দীর্ঘ ১০ দিন ছুটি কাটানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় তার কর্মস্থলে ফিরেছেন। এরই মধ্যে গতকাল ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। দীর্ঘ ওই বৈঠকে বাংলাদেশে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভোট আয়োজনের তাগিদ দেয় ইউরোপের ২৭ দেশের এই জোট। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো এক চিঠিতে ‘শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য জরিমানা ও ভিসা বিধিনিষেধের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ’— এমন আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। চিঠিতে এ-ও বলা হয়েছে, সম্ভাব্য জরিমানা ও ভিসা বিধিনিষেধের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট আয়োজন ইসির জন্য ‘চ্যালেঞ্জিং’ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুকদের মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার শেষ দিন আজ ৩০ নভেম্বর। এ সময়ের মধ্যেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র দলগুলো ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত না জানানোয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা প্রধান বিরোধী দল অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থানে থাকায় প্রতিযোগিতামূলক ভোট নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ইসি একটি একতরফা ভোটের আয়োজন করছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে ভিন্ন কথা, তারা দাবি করছে ইসির রেফারির ভূমিকায় থাকে, আছেও। কিন্তু সব প্লেয়ার যদি মাঠে না নামেন তাহলে ইসির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকে আর কি করতে পারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট অনুষ্ঠানে বাধ্যবাধকতা থাকায় ভোট আয়োজন ছাড়া ইসির কাছে সুন্দর বিকল্প নেই।
ইউরোপের ২৭টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই ইইউর একটি প্রতিনিধি দল গতকাল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়।’ চার্লস হোয়াইটলি বলেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত মতবিনিময় হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও তার টিম খোলামেলা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনেছি। আমরা আশা করি গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। পুরো বিশ্বও এটি দেখতে চায়। বিকেল ৩টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে হোয়াইটলির সঙ্গে সাত দেশের রাষ্ট্রদূত, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ইইউ ইলেকশন এক্সপার্ট মিশনের প্রতিনিধিদলের চারজন হলেন— ডেভিড নোয়েল ওয়ার্ড (ইলেকশন এক্সপার্ট), আলেকজান্ডার ম্যাটাস (ইলেকটোরাল এনালিস্ট), সুইবেস শার্লট (ইলেকটোরাল এনালিস্ট) এবং রেবেকা কক্স (লিগ্যাল এক্সপার্ট)।
ইইউর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ইইউ ডেলিগেশনের (প্রতিনিধিদল) সঙ্গে বসেছিলাম। তারা এর আগেও একাধিকবার এসেছেন। সহসাই তাদের একটা এক্সপার্ট টিম নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আমাদের এখানে আসবেন বলে তারা জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে চারজন এসে পৌঁছেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এটা তারা জানতেন না। এটা আমরা তাদের জানিয়েছি। আমরা তাদের জানিয়েছি নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার, পিসফুল অ্যান্ড ক্রেডিবল করতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আরও জানিয়েছি, আমাদের কমিশনাররা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তারা জনগণ এবং প্রশাসনকে এসব বিষয় অবহিত করছেন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হয়। আমরা যতদূর বুঝেছি তারা আমাদের কথায় সন্তুষ্ট হয়েছেন।’ সিইসি বলেন, ‘একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে আমরা যে আইনত এবং সাংবিধানিকভাবে বাধ্য, সেটা আমরা স্পষ্ট করে তাদের বুঝিয়েছি। এটা আমরা আগেও তাদের বুঝিয়েছিলাম। আমাদের যে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, আমার বিশ্বাস, এটা তারা বুঝতে পেরেছেন। আর পলিটিক্যাল বিষয়টা আমরা তাদের বলেছি, যদি কোনো মতবিরোধ থাকে, আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আমরা শুধু সেখানে এনগেজ থাকতে পারি।’
এদিকে গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো এক চিঠি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। ওই চিঠিতে ‘শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য জরিমানা ও ভিসা বিধিনিষেধের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ, এমন আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে বলে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের বরাত দিয়ে দেশের একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় চিঠি পেয়েছে। তবে এটি কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটি স্বাভাবিক যোগাযোগ।
দূতাবাস জানায়, ‘স্মারকলিপি’ অনুযায়ী, মার্কিন পররাষ্ট্র মিশন সরাসরি শ্রম ইস্যুগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বা মোকাবিলা করবে। এই নীতি মার্কিন কূটনীতিক বা মিশনগুলোকে অনেক অভ্যন্তরীণ বা জাতীয় ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করতে পারে। যদি তারা মনে করে বা বিশ্বাস করে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। দূতাবাসের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘স্মারকলিপি’র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ আছে। স্মারকলিপিতে শ্রম অধিকার নিয়ে যা বলা হয়েছে তার পেছনে রাজনীতি আছে এবং যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে। সুতরাং এই ‘স্মারকলিপি’ বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা, কারণ যুক্তরাষ্ট্র শ্রম ইস্যুর অজুহাতে স্মারকলিপিতে বর্ণিত যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। এই স্মারকলিপি বাংলাদেশের পোশাক খাতেও প্রভাব ফেলতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের তাই অগ্রাধিকার দিয়ে এটি বিবেচনায় নেয়া উচিত।
বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের মাঠে নেই। এ পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত চোখ রাঙানি মাথায় রেখেই গত ২৭ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাহির থেকেও থাবা, হাত এসে পড়েছে। তারা থাবা বিস্তার করে রেখেছে।’ দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল এ-ও বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে এখন যে বিতর্ক, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নির্বাচনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নির্বাচনের ফেয়ারনেসকে উপলক্ষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে গেছে, এটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না।