ডয়চে ভেলে
শেষ পর্যন্ত বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো আসনেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়নি।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) বিকাল ৪টায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের তফসিল পুনর্নিধারণের কোনো সুযোগ নেই।’ ফলে প্রশ্ন উঠেছে এই নির্বাচনকে কী অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আর বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক অন্তত আমি বলতে পারব না।’
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। এ পর্যবেক্ষণে আমাদের ধারণা হয়েছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা আমরা এবারও দেখতে পাচ্ছি না।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসল কিনা তার চেয়ে বড় কথা হল, জনগণ যদি ভোট দেয় তাহলে সেটাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।’ কত শতাংশ ভোট পড়লে সেটাকে আপনারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘সেই সংখ্যা বলতে পারব না। তবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি আসেনি, তবুও ৪৮ থেকে ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল।’
বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনেও বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোন আগ্রহ দেখানো হয়নি। নির্বাচন কমিশন আগে থেকেই যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল, বিএনপি নির্বাচনে আসলে তফসিল পরিবর্তন করা হবে। ফলে বিএনপি নির্বাচনে না আসায় নির্বাচন কমিশন তফসিল পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করেনি। ইসি সচিব বৃহষ্পতিবার পরিষ্কার বলেছেন, ‘এ অবস্থায় নির্বাচনের তফসিল পুনর্নিধারণের কোনো সুযোগ নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, প্রার্থীরা রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এই নির্বাচনে কয়টি দল কোন আসনে অংশগ্রহণ করছে তা শুক্রবার জানানো হবে।
নির্বাচনী আচরণ বিধি প্রতিপালন বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সাক্ষাৎ করেছিলেন। বিশেষ করে আইজিপি সামগ্রিক বিষয় অবহিত করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কোনো নির্দেশনা আছে কিনা তা জেনে নিয়েছেন। এছাড়া কিছু কিছু প্রার্থী কোনো কোনো জায়গায় আচরণবিধি ভঙ্গ করায় আমাদের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি তাদেরকে তলব করেছে। এছাড়া রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে নির্বাহী হাকিমরাও কাজ করছেন।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বিএনপি ভোটে আসছে না। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে কোন নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না। জাতীয় পার্টির আগে একটা অবস্থান ছিল। এই নির্বাচনের পর তাদের সেই অবস্থান কতটুকু থাকবে সেটাও দেখার বিষয়।’
বৃহস্পতিবার বেলা সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত ‘গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার চর্চার রাজনৈতিক অঙ্গীকার : টিআইবির সুপারিশমালা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা বা ভোটের ওপর জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে বলে মনে করি।’
প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বে বহাল থাকায় নির্বাচনে দলীয় বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘যখন একটি দল নির্বাচিত হয়, সেই দল দেশের সরকার হিসেবে নির্বাচিত হয়। তখন সেই সরকার আর কোনো দলের সরকার থাকে না। কিন্তু সেই সরকারের প্রধান যদি স্বপ্রণোদিতভাবে দলীয় নেতৃত্বের অবস্থান থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে প্রতীকী অর্থে হলেও সবার সরকার প্রধান হিসেবে বা সব দলের সরকার হিসেবে তার ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। সংসদের স্পিকারের ক্ষেত্রেও একই কথা। স্পিকার যখন নির্বাচিত হন তখন আর কোনো দলের প্রতিনিধি থাকেন না। তখন তিনি সব এমপির স্পিকার। দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক জোট দ্বারা একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার ঘাটতির ফলে বারবার গণতান্ত্রিক পথ থেকে বিচ্যুতি ও নির্বাচনকালীন সহিংসতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’
নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা আবারও বললেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, ‘যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে সেটি তো তামাশার নির্বাচন। ফলে এই নির্বাচনে আমরা অংশ নিচ্ছি না।’ তাহলে বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আর নির্বাচনে বাধা দিতে পারব না। কারণ পুলিশ, র্যাব, প্রশাসন সবই তাদের সাজানো। ফলে আমরা আমাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাব। আমরা বিশ্বাস করি এই সরকারের পতন হবে। আমাদের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
গত ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তফসিল ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ১ থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রার্থীরা ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ হবে। ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হবে। এবার সব আসনে ভোট হবে ব্যালট বাক্সে। এই নির্বাচনে সারা দেশে ৪২ হাজার ১০৩টি ভোটকেন্দ্রের অধীনে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সমীর কুমার দে। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।