নিজস্ব প্রতিবেদক
জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে বিখ্যাত আমেরিকান সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইক। নিবন্ধটি তিনি যৌথভাবে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেনের সঙ্গে লিখেছেন। ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত নিবন্ধটিতে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ের দায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপায় খুঁজে বের করতে বিশ্ব নেতারা দুবাইতে কপ-২৮ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে সমবেত হয়েছেন। এরই মধ্যে নিউজউইকে প্রকাশ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধ।
এতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন হলো একটি বৈশ্বিক বিপর্যয়, যা গরিবদের ওপর ধনীরা চাপিয়ে দেয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে এটি তাদের নিজেদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দুবাইতে কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে আমন্ত্রিত বিশ্ব নেতাদের বুঝতে হবে যে, তাদের টপ-ডাউন (ওপর থেকে নিচে) পদ্ধতি কখনো কাজ করতে পারে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ের জন্য আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদের দায়িত্ব দিতে হবে এবং এই লড়াইয়ে তাদের অর্থায়ন করতে হবে।
বিশ^ নেতাদের মতবিরোধে জলবায়ু বিপর্যয় থেমে থাকবে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, জলবায়ু তহবিলের একটি ক্ষুদ্র অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করা মানুষের কাছে পৌঁছায়Ñ তাদের নিজেদের এবং জীবিকা রক্ষার প্রয়োজনীয়
সংস্থান ছাড়া তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। জলবায়ু অনাচার ও বৈষম্য আরও বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্তদের সামনের কাতারে থাকা মানুষ রক্ষায় সাহায্য না করলে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু কার্যক্রমের কোনো মানে হয় না বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি লেখেন, ‘আমাদের স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক উদ্যোগের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় তহবিল দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে হস্তান্তরের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য নতুন চিন্তাভাবনা এবং নতুন উদ্ভাবনার প্রয়োজন।
কপ২৮-এ অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, ক্ষতিগ্রস্ত তহবিলটি অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হতে হবে, যাতে আমরা অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং জলবায়ু প্রভাবগুলোর সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে খাপ খাইয়ে নিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে দ্রুত এবং জরুরি ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
জলবায়ু প্রতিশ্রুতির অর্থ যথাযথ প্রকল্প পৌঁছায় না নিবন্ধে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি লেখেন, ‘কোন শহর, রাস্তা, মাঠ এবং বাড়ি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তা তারাই জানে যারা সেখানে বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের অবশ্যই তাদের একত্রিত হতে এবং তাদের নিজস্ব প্রকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং ক্ষমতায়িত করতে হবে।’
নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, ‘এটি বলা সহজ, করা কঠিন। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রায়শ সময় এবং দক্ষতার অভাব হয়। প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করতে তাদের সাহায্য এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং তহবিল সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের মৌলিক জিনিসগুলোর প্রয়োজন যেমনÑ আইনিভাবে গঠিত সংস্থা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।’
জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানের কথা উল্লেখ করে নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, ঢাকায় গ্লোবাল হাব অন লোকালি লিড অ্যাডাপ্টেশনের মাধ্যমে সরকার সমাধান জোরদারে এবং বিশ্বের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সর্বোত্তম চর্চার বিনিময় করতে সহায়তা করছে। এই প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে নাটকীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় মংলায় নেওয়া উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি লেখেন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলায় জলবায়ু চ্যালেঞ্জের মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ চিহ্নিত করতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করছেন মেয়র এবং বাসিন্দারা। অন্যান্য বড় শহরগুলোর মতো, মংলা জলবায়ু অভিবাসীদের একটি বড় আগমন দেখেছে, শহরটি ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলস্বরূপÑ শহরের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ দূষিত হচ্ছে। মংলা জনবসতির মানচিত্র তৈরি করছে, জলবায়ুর প্রধান দুর্বলতা চিহ্নিত করছে এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন উদ্যোগের উন্নয়ন করছে। ব্র্যাক, একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং এটি যুক্তরাজ্য এবং কানাডার সরকারের সহায়তায় গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে কাজ করছে। আশা করা যায়, মংলার জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া অন্যান্য শহর ও শহরগুলোর জন্য একটি ব্লুপ্রিন্ট হয়ে উঠতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, এটি দেখিয়েছে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন এগিয়ে যাওয়ার পথ। তবে আমাদের এই পদ্ধতিগুলো ব্যাপকভাবে জোরদার করতে হবে। এজন্য দাতাদের জন্য অযাচিত ঝুঁকি তৈরি না করে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে অর্থায়ন করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোসহ বৃহৎ অর্থদাতাদের পোর্টফোলিওতে জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাগুলোকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি ট্রান্সমিশন বেল্ট হিসেবে কাজ করার জন্য শক্তিশালী মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলো এখানে মূল্যবান হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, কপ-২৮ তখনই সফল হবে যখন এটি জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটির জন্য প্রকৃত সুবিধা অর্জন করবে। এই বছরের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র সম্প্রদায়ের কাছে অর্থ প্রবাহ এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব, উপযুক্ত এবং কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এটি অর্জন করতে পারি, তা হলে সেটি হবে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর অবিচার প্রতিকারের একটি বড় পদক্ষেপ।