করোনাভাইরাস মহামারীর পর থেকে চীনে খেলাপিঋণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। একই সঙ্গে মহামারীর পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।
চীনের স্থানীয় আদালতের তথ্যানুসারে, মোট ৮৫ লাখ ৪ হাজার লোক বাড়ি বন্ধক থেকে ব্যবসায়িক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এ পরিসংখ্যান চীনা প্রাপ্তবয়স্ক কর্মজীবীদের প্রায় ১ শতাংশের সমান। এ সংখ্যা ২০২০ সালের প্রথম দিকে ৫৭ লাখ ঋণখেলাপির চেয়ে বেশি। মহামারীকালের লকডাউন ও অন্যান্য বিধিনিষেধ এদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে এবং পরিবারের আয় হ্রাস করে দিয়েছে।
চীনা আইনে কালোতালিকাভুক্ত খেলাপিদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিমানের টিকিট না কিনতে পারা এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে না দেয়া।
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা চীনে ভোক্তাদের আস্থার সংকট তৈরি করছে। এটি দেশের ব্যক্তিগত দেউলিয়া আইনের অভাবের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এছাড়া খেলাপি ঋণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। রিয়েল এস্টেট খাতের মন্দা ও ভোক্তার আস্থা না থাকায় অর্থনীতি আরো সংকুচিত হতে পারে।
একজন ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ঋণদাতা মামলা করলে এবং পরবর্তীকালে কিস্তি পরিশোধ না করলে তাকে কালো তালিকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
হ্যাং সেং ব্যাংক চায়নার প্রধান অর্থনীতিবিদ ড্যান ওয়াং বলেন, ‘ˆখলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু চক্রবৃদ্ধি নয়, কাঠামোগত সমস্যাও তৈরি করছে। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার আগে আরো খারাপ হতে পারে।’
ব্যক্তিগত ঋণ সংকট চীনা ভোক্তাকে আরো বেশি ঋণ নিতে প্ররোচিত করতে পারে। বেইজিংভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মতে, গত এক দশকে মোট জিডিপির হিসাবে গৃহস্থালি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ায় অর্থনীতি ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছে। অনেক ঋণখেলাপি কিস্তি পরিশোধ করতে লড়াই করছেন, অনেকে বাধ্য হয়ে বিল পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন, অনেকে কাজ খুঁজছেন। সব মিলিয়ে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা স্বস্তির নয়। জুনে যুব বেকারত্ব রেকর্ড ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ নতুন তথ্য সরবরাহ করতে চাইছে না।
গত মে মাসে ছাঁটাই হওয়ার পর ঋণের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ সাংহাইভিত্তিক অফিস কর্মী জন ওয়াং বলেন, ‘যখন আমার চাকরি হবে, তখন আমি আমার ২৮ হাজার ইউয়ান ক্রেডিট কার্ড ব্যালান্স পরিশোধ করব। আমি জানি না এটা কখন হবে।’
চায়না মার্চেন্টস ব্যাংক এ মাসে জানায়, ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্টজনিত ব্যাড লোন (৯০ দিনের বেশি বকেয়া) ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে।
সাংহাইভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চায়না ইনডেক্স একাডেমির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে চীনে ৫ লাখ ৮৪ হাজার ফোরক্লোজার (বন্ধকি সম্পত্তি দখল নেয়ার পদক্ষেপ) চিহ্নিত হয়েছে। এটা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি।
কালো তালিকাভুক্ত ঋণগ্রহীতাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ তারা রাষ্ট্র-আরোপিত কয়েক ডজন বিধিনিষেধ মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছে। ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি তাদের টোল দিতে হয় এমন রাস্তা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হচ্ছে।
একটি ব্যাংকে ঋণখেলাপি হওয়া দক্ষিণ-পূর্ব জিয়াংসি প্রদেশের বিজ্ঞাপন সংস্থার স্বত্বাধিকারী জেন ঝাং বলেন, ‘স্থানীয় আদালত মে মাসে শিশুর জন্য খাবার কেনার ক্ষেত্রে ওয়েচ্যাট (অ্যাপ) পে ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে আমি আতঙ্কিত হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমার ছেলে ক্ষুধার্ত থাকবে। কারণ আমার হাতে কোনো নগদ টাকা নেই। তার আগে আমি সব কেনাকাটা ওয়েচ্যাটের মাধ্যমে করতাম।’ পরে অবশ্য তিনি অন্যান্য শাস্তি বহাল রেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে আদালতকে রাজি করিয়েছেন।
এদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা ব্যক্তিগত দেউলিয়াত্বের ক্ষেত্রে ঋণ মওকুফসহ ব্যক্তিগত দেউলিয়া আইন প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছেন।