অর্থনৈতিক সংকট প্রকাশ পাচ্ছে

অর্থনৈতিক সংকট প্রকাশ পাচ্ছে

টালমাটাল অর্থনীতিকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি পেয়েই এর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। ফলে রপ্তানি খাতে শঙ্কা ও হতাশা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক প্রভাব তৈরির কথা বিবেচনা করে ব্যবসায়ীরা এত দিন চুপিসারে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন। এখন শঙ্কার কথা স্পষ্ট করে বলতে শুরু করেছেন তারা। প্রধান রপ্তানি খাতে আঘাত আসা শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। ফলে স্যাংশনের আগেই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। ইতোমধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের পতনে বৈদেশিক বাণিজ্যে অস্থিরতা বিরাজমান। ধারাবাহিক ক্ষয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জরুরি পণ্য আমদানিতে অব্যাহত রয়েছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি। কূটনৈতিক অস্থিরতায় আইএমএফসহ দাতা গোষ্ঠীগুলোর অর্থছাড়ও বন্ধ হতে পারে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে স্যাংশন দেশের অর্থনীতিকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে অর্থনীতির সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ভয় ও হতাশার মধ্যে আছেন উদ্যোক্তারা। বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে দিন পার করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু হয়ে গেছে। ক্রেতারা শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে অর্থছাড় করা হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ঋণপত্র খুলতে অপারগতা প্রকাশ করতে পারে ব্যাংক। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এলসি খুলতে সতর্ক হচ্ছে ব্যাংকগুলো। নানামুখী দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কাঁচামাল আমদানিকারকরা।

পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান জানিয়েছেন, দেশের পোশাক খাতের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে নানা ধরনের চাপ আসছে। গত মঙ্গলবার সংকট উত্তরণে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘ইউএস থেকে ইস্যু আছে আপনারা দেখেছেন যে প্রেসিডেন্ট মেমোরেন্ডাম সাইন করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওরাও ভিজিট করে গেছে, সেটারও প্রেশার। ক্রেতারা এরই মধ্যে ক্লজ দিয়ে গেছে যে, স্যাংশন হলে পেমেন্ট তো দূরের কথা তারা গুডস নেবে না, গুডস দিলেও পেমেন্ট দেবে না । এই ক্লজে আমাদের ব্যাংক এলসি খুলবে না।’ জানা গেছে, বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে পণ্য না নেয়া কিংবা অর্থ পরিশোধ না করার শর্ত যুক্ত করে তৈরি পোশাকের ঋণপত্র দিয়েছে একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এর পরই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করে ফারুক হাসান বলেন, একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো ঋণপত্রের সাধারণ শর্তের মধ্যে বলেছে, বাংলাদেশ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে তারা পণ্য নেবে না। যদি পণ্য জাহাজীকরণের পরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলেও অর্থ দেবে না ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

 

তবে কোন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এমন শর্ত দিয়েছে কিংবা কোন পোশাক কারখানাকে এমন শর্ত দেয়া হয়েছে, তা জানাননি বিজিএমইএ সভাপতি।

বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ফারুক হাসান বলেন, নতুন শর্ত দেয়ায় দুশ্চিন্তা একটু বাড়ল। কারণ, এতে করে অনেক ব্যাংক মূল ঋণপত্রের বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলতে না-ও পারে। তার কারণ হচ্ছে, নতুন এই শর্তের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির পর অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিতে কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়। আবার ক্রেতা পণ্য না নিলে স্টক হয়ে যেতে পারে। নিষেধাজ্ঞা এলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, বাণিজ্যের বিধিনিষেধ এমন একটি ক্ষতিকর প্রক্রিয়া যা একটি দেশকে মুহূর্তেই অস্থির করে তুলতে পারে। বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর দেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি সমস্যার। কারণ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যুত, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মতো পণ্য আমদানি করতে হয় বাংলাদেশের। শিশুখাদ্যসহ প্রয়োজনীয় বহু পণ্য আমদানি হচ্ছে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ব্যক্তির ওপর স্যাংশন বা সংস্থার ওপর স্যাংশন এটি ওদের ব্যাপার। এটাতে কিছু আসে-যায় না। কিন্তু বাণিজ্যের স্যাংশন অত্যন্ত বড় বিষয় বাংলাদেশের জন্য। একটিই মাত্র পণ্য। এর ওপর নতুন বিধিনিষেধ হলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ এখন বড় আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিলাম, যে পর্যায়ে নেমেছে, সেটি ধরে রাখেন, আর অবনমন করতে দেবেন না। কারণ এরপরে আরও নামলে স্পেকুলেশন অনেক বেড়ে যাবে।’

নাজুক শ্রম পরিবেশ ও নীপিড়নের মতো নানা অজুহাতে বাণিজ্য নিষধাজ্ঞা আরোপের হুমকি এলেও বিষয়টি রাজনৈতিক। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার ফলে এতে যুক্ত হয়েছে বিদেশি শক্তিগুলো। পশ্চিমাবিরোধী দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে এক তরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। অপরদিকে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার দাবি তুলে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা। আগমী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলগুলো এতে সাড়া দিলেও সরকারি দল বিষটি নাকচ করে দিয়েছে। এরপরই একের পর এক নিষেধাজ্ঞার হুমকি আসতে শুরু করে। ইতোমধ্যে সামুদ্রিক প্রাণী ও এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র গত ১৬ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার সুরক্ষায় নতুন নীতি ঘোষণা করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ নীতি প্রকাশকালে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবে, শ্রমিকদের হুমকি দেবে, ভয় দেখাবে, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়। ফলে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে— এমন বার্তা আসে ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে। গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির বিষয়ে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করে বাণিজ্যসচিবকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এই নীতি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। তাই একতরফা নির্বাচন অর্থনীতির জন্য কতটা খারাপ পরিণতি ডেকে আনতে পারে সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ— সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইচ্ছে পূরণের নির্বাচন শুভ ফল দেবে না’। বর্তমানে দেশ তিনটি সংকটে রয়েছে— রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্কজনিত সংকট। এ সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিদ্যমান আইনের আদেশ বলে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি রয়েছে।

ইতোমধ্যে কল্পনা আক্তারের বিষয়টি সামনে এসেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব ‘কল্পনা’। বৈদেশিক সম্পর্কের অবনতি বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে যেসব বাক্য ব্যবহার করা হয় তা কূটনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করে। অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দুটোই কমছে। নভেম্বরে রেমিট্যান্স আগের মাসের চেয়ে কম এসেছে। টানা দুই মাস পতন হয়েছে রপ্তানি খাতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুত ঋণ ছাড়ের বিষয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ সরকারি দলের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের আহ্বান নাকচ হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

আগামী ১২ ডিসেম্বর আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদনের কথা রয়েছে। সংস্থাটির বোর্ডে ঋণ কর্মসূচিটি স্থগিত হয়ে গেলে অন্য দাতাগোষ্ঠীরাও অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ আইএমএফকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচনা করে অন্য সংস্থাগুলো। আর আইএমএফের সবচেয়ে বড় শেয়ার ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বর্তমানে দেশের রিজার্ভ তলানিতে অবস্থান করছে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিষয়টি উল্লেখ করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কারণ ধারাবাহিক পতন হতে থাকা রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়নে (ব্যবহার যোগ্য) অবস্থান করছে। যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। এরপরও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। কেননা জরুরি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিতে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত ডলার নেই। এমন পরিস্থিতিতে স্যাংশন এলে এবং দাতাগোষ্ঠীগুলোর অর্থছাড় বন্ধ হলে দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে নিপতিত হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ