আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সস্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোও তাদের প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে সব প্রস্তুতি নিয়েছে। এদিকে বিএনপি তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। দলটি বলছে, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন রকম কর্মসূচি দিয়ে মাঠে রয়েছে বিএনপি। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না-এই দাবিতেও সোচ্চার বিএনপি। ঘোষিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে সরব দলটি।
২৮ অক্টোবর বিএনপির ঢাকা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সেদিন দুপুর থেকে রাজধানীতে জ্বালাও, পোড়াও, হামলা, ভাঙচুরসহ সৃষ্ট ঘটনায় মামলা এবং সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের। অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তারপর কারাগারের বাইরে থাকা নেতাকর্মীরা নির্বাচনের কার্যক্রম ঠেকাতে অবরোধ-হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। নির্বাচন ঠেকাতে দলের পক্ষ থেকে নেতারা খুঁজছেন নতুন কৌশল।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি ও তার শরিক বেশ কয়েকটি দল। ৭ জানুয়ারির ভোট ঠেকাতে কৌশল নির্ধারণে ইতোমধ্যেই মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করেছে বিএনপি। এছাড়া যুগপতের বাইরে থাকা যেসব দল নির্বাচনে যায়নি, নির্বাচন প্রতিহত করতে তাদের সঙ্গেও সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস কিংবা আগ্রহ কোনোটাই নেই। এটি ইতোমধ্যেই স্পষ্ট যে, নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। নির্বাচনের ফলাফল ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনের কারণে মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন চিরতরে ফুরিয়ে গেছে। ক্ষমতার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে এই যে নির্বাচন নির্বাচন খেলা, সেটির পরিণাম কখনোই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।
মঈন খান বলেন, বিএনপি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য, জনগণের ভোটাধিকার পুনর্বহালের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন চলতেই থাকবে, যতদিন না গণমানুষের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল পাতানো নির্বাচন বর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বও এই নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার প্রশ্ন তুলেছে। তারা যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল, সরকার তা আমলেই নেয়নি। ফলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকও পাঠাচ্ছে না। কারণ, তারা বুঝে গেছে, নির্বাচনের নামে এখানে কত বড় প্রহসন হতে যাচ্ছে।
‘মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দেশে জনগণের আন্দোলন কখনোই বৃথা যায়নি, এবারও যাবে না। সরকার মনে করেছে, আগের মতো এবারও একতরফা একটি নির্বাচন করে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্ষমতায় থাকবে, সেটা হওয়ার নয়, কেননা এখন ২০১৪ বা ২০১৮ নয়,’ বলেও জানান ড. মঈন খান।
বিএনপি ও যুগপৎ শরিক দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেহেতু মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়ে গেছে এবং জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, সে কারণে আন্দোলনের কর্মকৌশল ও পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে গত কয়েকদিনে দলের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। সম্প্রতি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে হাইকমান্ড। বর্তমান পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ইতোমধ্যে এই কর্মসূচির ব্যাপারে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি নেতারা আত্মগোপনে থেকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে নেতারা বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে সরাসরি মাঠে নামতে পারছেন না। সে কারণে কৌশলের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এসব কর্মসূচি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে চাচ্ছে বিএনপি। দলটির প্রাথমিক পরিকল্পনা হচ্ছে, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে আবারও হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। নির্বাচনের দিন (৭ জানুয়ারি) সারা দেশে হরতালের ডাক দেওয়ারও পরিকল্পনা করছে দলটি। তবে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, এরপর কিছুদিন লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিতে পারে বলেও জানা গেছে।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বিভিন্ন জোটগুলোকে এক মঞ্চে আনার কথা ভাবছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিককে নিয়ে একত্রে বৈঠক করেছে দলটি। আন্দোলন বেগবান করতে সেখানে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে যুগপতে থাকা ৩৯টি দল ছাড়াও বাইরে থেকে এবি পার্টি অংশ নেয়। এছাড়া নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটকেও সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, সরকারের আসন্ন ‘একতরফা’ নির্বাচন ঠেকানোর কর্মকৌশল নিয়েও। এর অংশ হিসেবে তফশিল বাতিলের দাবির পাশাপাশি ভোটারদের ভোট বর্জন করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।
আগামী দু-একদিনের মধ্যে যুগপতের ৩৯ দল আবারও বৈঠকে বসবে বলে জানা গেছে। সেখানে যুগপতের বাইরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং সমমনা ইসলামী দলগুলো নামের মোর্চাকেও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একজন শীর্ষ নেতা বলেন, সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় এক দফার আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন বর্জন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোকে যুগপতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করা হচ্ছে। যদি যুগপতে সম্পৃক্ত হতে রাজি না হয়, তাহলে তারা আগের মতো নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলন করবে। বাম গণতান্ত্রিক জোট ছাড়া অন্য দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ ১৪টি দল ভোটে যায়নি। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) নির্বাচন করছে। শেষদিনে দল দুটির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের সবগুলোই অংশ নিয়েছিল। আর বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল বর্জন করলেও দশম সংসদ নির্বাচনে ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল।