বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকা
বর্তমান সংসদে থাকা আওয়ামী লীগের ৭৭ জন সদস্য এবার দলীয় মনোনয়ন হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৬০ জন ভোটের লড়াইয়ে থাকার সাহস করেননি। দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ১৭ জন বর্তমান সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, আগের দুটি সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে এবার সবচেয়ে বেশি সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন। তবে দুর্নীতি, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ যেসব মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ছিল, তাঁদের মধ্যে বাদ পড়ার সংখ্যা খুবই কম। এবার কিছু আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যকে বাদ দিতে হয়েছে তারকা, ক্রিকেটার ও সাবেক আমলাদের জায়গা করে দিতে। আর কিছু বাদ পড়েছেন দলীয় কোন্দলের কারণে। অনেক আসনে কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের জায়গা দিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এ ছাড়া বয়স ও অসুস্থতার কারণে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়েছেন কয়েকজন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন তাঁদের পরিবারেই আছে। বাবার নৌকা সন্তানের হাতে উঠেছে ১১ আসনে।
‘এমপি লীগে’র নিয়ন্ত্রণে আ. লীগ
২০১৮ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ৪৮ জন সংসদ সদস্য বাদ পড়েছিলেন। বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাদ পড়েছিলেন ৬৩ জন।
এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন তিন প্রতিমন্ত্রী। তাঁরা হলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জাকির হোসেন স্বতন্ত্র মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকেননি। বাকিরা ভোটের চেষ্টাই করেননি।
এবার কিছু আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যকে বাদ দিতে হয়েছে তারকা, ক্রিকেটার ও সাবেক আমলাদের জায়গা করে দিতে। আর কিছু বাদ পড়েছেন দলীয় কোন্দলের কারণে। অনেক আসনে কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের জায়গা দিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
‘কপালে নেই বলে হয়তো বাদ’
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় চালানোয় অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। মন্নুজান সুফিয়ান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম কিংবা খারাপ কাজ করিনি। কপালে নেই বলে হয়তো বাদ পড়েছি।’ তবে তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করার চিন্তা করেননি।
আরেকজন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর মন্ত্রীর সরকারি বাসায় ভুক্তভোগীদের ডেকে এনে মারধর এবং পরে টাকা ফেরত দেওয়ার ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
৩২ আসন ছাড়ল আওয়ামী লীগ
প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জনবিচ্ছিন্নতার। এ ছাড়া দলের ভেতরে দলাদলিতে ইন্ধনের অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে বাদ পড়ে স্বতন্ত্র ভোট করছেন বর্তমান সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। তিনি ক্যাসিনো ও জুয়ার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে পরিচালিত অভিযান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সমালোচিত হন। অবশ্য সামশুল হক মনে করেন, নানা ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন।
ঢাকা-১০ আসন থেকে ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন সংসদ সদস্য হন ২০২০ সালের উপনির্বাচনে। চার বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি বাদ পড়েন। চিত্রনায়ক ফেরদৌসকে জায়গা দিতেই বাদ পড়েন তিনি।
প্রভাবশালীদের জায়গা দিতে বাদ
২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে ঢাকা-১৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। একবার প্রতিমন্ত্রীও হন। তবে ২০১৮ সালে নানা কারণে কোণঠাসা হয়ে বাদ পড়েন তিনি। সাদেক খান দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। এবার নানক দলীয় মনোনয়ন পান। তাঁকে জায়গা দিতে বাদ পড়েন সাদেক খান।
মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. সাইফুজ্জামান দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও নানা কারণে বিতর্কিত হন। তবে তাঁকে এবার বাদ দেওয়ার পেছনে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে জায়গা দেওয়াই মূল কারণ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
শরিক ও মিত্রদের ছাড় দিয়েই ভোটে আওয়ামী লীগ
ঢাকা-১০ আসন থেকে ব্যবসায়ী নেতা শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন সংসদ সদস্য হন ২০২০ সালের উপনির্বাচনে। চার বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি বাদ পড়েন। চিত্রনায়ক ফেরদৌসকে জায়গা দিতেই বাদ পড়েন তিনি।
সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে বাদ পড়েছেন প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা। তাঁর বাদ পড়ার পেছনে বড় কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। এই আসনে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মাহমুদ। তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের ভাই। অবশ্য জয়া সেনগুপ্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করছেন।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদকে বাদ দিয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে যাওয়া আবদুল কাহার আকন্দকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-১৪ আসনে আগা খান সংসদ সদস্য হন আসলামুল হক মারা যাওয়ার পর, ২০২১ সালের জুনে। সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খানকে। দলের ভেতর আলোচনা আছে, আগা খান কিছুটা নরমসরম। সে তুলনায় মাইনুল প্রভাবশালী।
জামালপুর-৫ আসনে গত নির্বাচনে প্রথমবার মোজফফর হোসেন মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। তবে তাঁর বদলে মনোনয়ন পেলেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সরকারের এসডিজি বাস্তবায়নবিষয়ক কমিটিতে মুখ্য সমন্বয়কেরও দায়িত্ব পালন করেন।
দুবারের সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খানকে বাদ দিয়ে ঝিনাইদহ-৩ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সালাহ উদ্দিন মিয়াজীকে। তিনি ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব ছিলেন। তাঁর বাবা ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদকে বাদ দিয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে যাওয়া আবদুল কাহার আকন্দকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কাহার আকন্দ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তের পাশাপাশি একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন।
ফরিদপুর-৩ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হককে। মোশাররফ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে আছেন। শেষ এক বছর সংসদের কার্যক্রমেও ছিলেন না। গত ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের উপদেষ্টা পরিষদের পদও হারান তিনি।
চিকিৎসকের পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হাবিবে মিল্লাত হঠাৎ করে ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন পান। তিনি খন্দকার মোশররফ হোসেনের জামাতা। এবার হাবিবে মিল্লাতের জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন জান্নাত আরা (হেনরী)। ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির প্রার্থী রুমানা মাহমুদের কাছে হেরে যান জান্নাত আরা। এরপর তাঁকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছিল।
নওগাঁ-৩ থেকে ছলিম উদ্দীন তরফদার দুবারের এবং নওগাঁ-৪ থেকে মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ছয়বারের সংসদ সদস্য। সূত্রগুলো বলছে, এ দুজন বিতর্কিত কাজের জন্য বাদ পড়েননি। তরফদার বাদ পড়েন সাবেক প্রভাবশালী সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তীকে জায়গা দিতে।
বাদ পড়ে স্বতন্ত্র
অশালীন, শিষ্টাচারবহির্ভূত ও নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে প্রতিমন্ত্রী ও দলীয় পদ দুটোই হারান মুরাদ হাসান। এবার স্বাভাবিকভাবেই দলীয় মনোনয়নও পাননি তিনি। কিন্তু জামালপুর-৪ আসন থেকে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
নওগাঁ-৩ থেকে ছলিম উদ্দীন তরফদার দুবারের এবং নওগাঁ-৪ থেকে মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ছয়বারের সংসদ সদস্য। সূত্রগুলো বলছে, এ দুজন বিতর্কিত কাজের জন্য বাদ পড়েননি। তরফদার বাদ পড়েন সাবেক প্রভাবশালী সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তীকে জায়গা দিতে। ইমাজ উদ্দিন বয়সের কারণে বাদ পড়েছেন। তবে দুজনই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে প্রথমে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের পদ, এখন দলীয় মনোনয়ন হারান পঙ্কজ নাথ। তবে বরিশাল-৪ আসনে স্বতন্ত্র ভোট করছেন তিনি। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাম্মী আহমেদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।
আপনি যদি এলাকায় এমপি থাকতে নিজের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন, তখন সেখানে স্বতন্ত্র ঢুকে গেলে আমরা কী করব? কাজেই নৌকার ইজ্জত নৌকার প্রার্থীদের রাখতে হবে।
ওবায়দুল কাদের
দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র হিসেবে আরও যেসব সংসদ সদস্য আছেন, তাঁরা হলেন মনোয়ার হোসেন চৌধুরী (গাইবান্ধা-৪), এনামুল হক ( রাজশাহী-৪), রণজিত কুমার রায় (যশোর-৪), মীর মোস্তাক আহমেদ (সাতক্ষীরা-২), ছানোয়ার হোসেন (টাঙ্গাইল-৫), আনোয়ারুল আবেদীন খান (ময়মনসিংহ-৯), ইকবাল হোসেন (গাজীপুর-৩), মোয়াজ্জেম হোসেন (সুনামগঞ্জ-১), আবদুল মজিদ খান (হবিগঞ্জ-২), জাফর আলম (কক্সবাজার-১)।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের দুজন সংসদ সদস্যও স্বতন্ত্র ভোট করছেন। এর মধ্যে মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাহমিনা বেগম। কুমিল্লা-৬ আসনে স্বতন্ত্র ভোট করছেন আনজুম সুলতানা।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে প্রথম ৭১ জন বর্তমান সংসদ সদস্য বাদ পড়েন। পরে শরিকদের সঙ্গে সমঝোতায় বাদ পড়েন আরও ছয়জন। এ ছাড়া কারাগার থেকে বেরিয়ে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন পান শাহাজান ওমর। বাদ পড়েন আওয়ামী লীগের তিনবারের সংসদ সদস্য বি এইচ হারুন।
গতকাল সিলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী জনসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও দলের মনোনীত প্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি যদি এলাকায় এমপি থাকতে নিজের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন, তখন সেখানে স্বতন্ত্র ঢুকে গেলে আমরা কী করব? কাজেই নৌকার ইজ্জত নৌকার প্রার্থীদের রাখতে হবে।’