প্রযুক্তি দুনিয়া ২০২৩ সালকে সম্ভবত মনে রাখবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূল ধারায় যুক্ত হওয়ার বছর হিসেবে। কোডিং থেকে আর্ট, রচনা, এআই- সিস্টেম খুব দ্রুতই বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করে দিতে পারে, যা হয়তো একেবারে নিখুঁত নয়। তবে নানান পেশা ও শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য দরকারি অনুসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে সৃষ্টিশীল এসব এআই।
মাইক্রোসফট, চ্যাটজিপিটি- ২০২২ সালের শেষদিকে এসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আসার পর থেকে, প্রতিদ্বন্দ্বী আরো অনেক কোম্পানিই এমন এআই নিয়ে কাজ করছে।
ডিসেম্বরে সবচেয়ে বড় চমক দিয়েছে অ্যালফাবেট; গুগলের মালিক এই কোম্পানি জেমিনিকে হাজির করেছে, এই এআই সমস্ত গুগল পণ্য, চ্যাটবট এবং সার্চ ইঞ্জিনেও যুক্ত হবে।
অ্যালফাবেট দাবি করছে, তাদের জেমিনি বর্তমান চ্যাটজিপিটিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তবে চ্যাটজিপিটি নিয়ে আসা ওপেনএআই বলছে তারাও বসে নেই। নতুন বছরে তাদের সফটওয়্যারের আরো একটা শক্তিশালী ভার্সন নিয়ে আসার ঘোষণা তাদের।
গত নভেম্বরে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের এক কনফারেন্সে ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেন, ‘আমরা এখন আপনাদের জন্য যেটা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছি, সেটার তুলনায় যা আমরা চালু করেছি তা সামনে দেখতে খুব অদ্ভূত মনে হবে।’
অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা এই শিল্পে প্রচুর অর্থ ঢালছেন এবং আশা করছেন যে তারা যেন এই সেক্টরের পরবর্তী জায়ান্টের পেছনে থাকতে পারেন।
ডেটা নিয়ে কাজ করা পিচবুকের হিসাব মতে, শুধু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্তই বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপের পেছনে ২১.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার বিনিয়োগ করেছে। যেখানে পুরো ২০২২ সাল জুড়ে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয় মাত্র ৫.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
তবে অনেকে সতর্কও করছেন এ নিয়ে অতি উৎসাহী না হতে। সিসিএস ইনসাইটের প্রধান অ্যানালিস্ট বেন উড বলছেন, ২০২৪ সালে জেনারেটিভ এআই একটু রয়েসয়ে এগুবে।
‘উচ্চাশা উপেক্ষিত হয়েছে এরইমধ্যে। আমরা মনে করি, আরো কিছু বাধা অল্প সময়ের জন্য হলেও এটার গতি কমিয়ে দেবে,’ বলেন তিনি।
তিনি মনে করিয়ে দেন একটা জেনারেটিভ এআই সিস্টেম তৈরি এবং সেটা চালু রাখা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। এর জন্য প্রচুর কম্পিউটিং পাওয়া এবং দামি সব কম্পিউটার চিপের দরকার হয় যার যোগান খুব সীমিত।
তার অনুমান খরচ বাঁচাতে কিছু এআই হাইব্রিড সিস্টেমে যাবে, যেখানে স্থানীয়ভাবে আপনার ল্যাপটপ বা ফোন থেকেই কিছু জিনিস প্রসেসিং সম্পন্ন হবে। উড আরো মনে করেন, বিভিন্ন নীতি ও আইনি মারপ্যাঁচও জেনারেটিভ এআই নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরি করেছে তাতে রাশ টানবে।
‘সংস্থাগুলো হয়তো এমন অবস্থায় পড়তে পারে যেখানে দেখা যাবে তারা অনেক অর্থ বিনিয়োগ করে ফেলেছে। কিন্তু নিয়ম-নীতির সাথে মানিয়ে নিতে এর কিছু অংশ ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে।’
ইলেকট্রিক শক
স্মেড অটোমোটিভ রিসার্চ বলছে, আগামী বছরের প্রথম তিন মাসেই যুক্তরাজ্যের রাস্তায় এক মিলিয়ন সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক কার নামতে যাচ্ছে। জার্মানির পর দ্বিতীয় বাজার হিসেবে যুক্তরাজ্য এই মাইলফলক স্পর্শ করবে।
এছাড়া ২০২৪ সাল ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল (ইভি) নির্মাতাদের জন্য একটা কঠিন বছর হতে যাচ্ছে।
২০২৩ সালের শেষদিকে এসে ফোর্ড, জিএম, টেসলা সবাই তাদের ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল নির্মাণ কাজ বাড়ানোর যে পরিকল্পনা সেটা আপাতত বন্ধ করে রেখেছে। অক্টোবরে মার্সিডিজ-বেঞ্জের দাম নিয়ে যুদ্ধ এবং সাপ্লাই চেইন জটিলতায় ইভির গোটা বাজারকে ‘নিষ্ঠুর’ বলে বর্ণনা করেছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা নতুন বছরে এসব সঙ্কট কমার কোনো লক্ষণ দেখছেন না। অটো মার্কেট অ্যানালিস্ট ম্যাথিয়াস স্মেড ২০২৪ সালে ইউরোপ জুড়ে বৈদ্যুতিক বাহন বিক্রি স্থবির থাকবে বলে মনে করছেন।
বিশেষ করে সাধারণত যে বাজারগুলো শক্তিশালী যেমন জার্মানি, নরওয়ে, সেখানে তিনি বিক্রি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না।
তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে নতুন জিরো এমিশন ভেহিক্যাল (জেডইভি) নীতি কার্যকর হওয়ায় এইটা একটা ভালো বাজার হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই নীতি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে বিক্রি হওয়া গাড়ির মাত্র এক পঞ্চমাংশের কিছু বেশি ইলেকট্রিক গাড়ি হতে হবে, যে লক্ষ্যটা ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে যারা ইলেকট্রিক গাড়ি কিনতে চান তাদের জন্য এসবই দারুণ খবর।
‘নির্মাতাদের এখন জেডইভি লক্ষ্যপূরণে ছুটতে হবে, ফলে বাজারটি হয়ে উঠতে যাচ্ছে ক্রেতা নির্ভর,’ বলেন স্মেড।
হিউম্যানয়েড রোবট, যা মানুষের মতো কাজ করতে সক্ষম, এগুলো নতুন বছরে আরো কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। টেসলা যেমন অপটিমাস নামের একটি হিউম্যানয়েড রোবট নিয়ে কাজ করছে, তাদের আশা এটি খুব দ্রুতই ফ্যাক্টরির সাধারণ কাজ করতে শুরু করবে।
এ মাসের শুরুর দিকে এক ভিডিওতে দেখা যায়, অপটিমাসের নতুন যে ভার্সন তা আগের যন্ত্রটির চেয়ে আরো হালকা। নতুন হাত এবং মটরও এতে যুক্ত হয়েছে।
গত জুলাইয়ে ইলন মাস্ক ঘোষণা দেন অপটিমাস ২০২৪ সাল থেকে টেসলা ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য উপযোগী হয়ে উঠবে।
‘এটি কবে থেকে কাজের উপযোগী হয়ে উঠবে, তা জানার জন্য আমরা একে প্রথমে আমাদের নিজেদের ফ্যাক্টরিতে কাজে লাগিয়ে দেখবে। আমি মনে করি, আগামী বছরের কোনো একটা সময় আমরা সেটি করতে সমর্থ হবে। এ ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।’
হিউম্যানয়েড রোবটে টেসলার প্রতিদ্বন্দ্বী আছে আরো অনেকে। অন্য অনেক কোম্পানির রোবট এরইমধ্যে অফিসে নানা কাজ করতে শিখছে।
অ্যামাজন তাদের ওয়্যারহাউসে একটি হিউম্যানয়েড রোবট পরীক্ষা করে দেখছে। ডিজিট নামের এই রোবটটি নড়াচড়া করতে পারে, হাত মুঠো করে অনেকটা মানুষের মতোই এটি জিনিসপত্র ধরতে পারে।
এ রোবটটি তৈরি করেছে অ্যাজিলিটি রোবোটিক্স আর তারা আশা করছে নতুন বছরে অন্যান্য কাস্টমারদের কাছেও তারা রোবটটি তুলে দিতে পারবে।
অন্যদিকে কানাডায় স্যানচুয়ারি এআই, ফিনিক্স নামের একটা রোবটকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এটি ব্যাগ ভরার মতো নির্দিষ্ট কাজও করতে সক্ষম। ২০২৪ সালে তাদের লক্ষ্য ফিনিক্সের কাজের পরিধি আরো বাড়ানো।
সামাজিক মাধ্যম টাকা নেবে না দেবেও
নানা নিয়ম নীতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইটগুলো মোটামুটি কঠিন সময়ই পার করছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
সবচেয়ে চাপে ইলন মাস্কের এক্স। টুইটার থেকে নাম পরিবর্তনের সাথে অনেকগুলো পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটি।
বিশেষ করে আর্থিক নীতিতে নানা পরিবর্তন এনেছেন তিনি। ব্লু টিকের জন্য সাবস্ক্রিপশন (যা পরে অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও অনুসরণ করেছে), থার্ড পার্টি অ্যাপ সরিয়ে নিয়ে নানা পেইড প্রোগ্রাম চালু এমনকি ফিলিপাইন ও নিউজিল্যান্ডে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য বার্ষিক এক ডলার ফিও চালু করেছে এক্স।
তবে এই মুহূর্তে বিজ্ঞাপনদাতাদের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে মাস্ক। ফোর্বস বলছে, সাইটে ৫৫ শতাংশ বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমে গেছে আর বৈশ্বিক ট্র্যাফিক কমেছে ১৪ শতাংশ।
বিজ্ঞাপনদাতাদের কড়া সমালোচনা করে ইলন মাস্ক বলেন, ‘অ্যাডভার্টাইজিং বয়কট তার কোম্পানিকে মেরেও ফেলতে পারে।’
নতুন বছরে তাই এক্সের ব্যবহারিক ও আর্থিক দুই ধরনের নীতিতেই পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে কানাডায় ভালো বিপদে পড়েছে মেটা। দেশটি তাদের নতুন অনলাইন নিউজ অ্যাক্ট পাশ করেছে যাতে সামাজিক মাধ্যম বা সার্চ ইঞ্জিন সাইট, নিউজ আউটলেটগুলোকে তাদের কন্টেন্ট ব্যবহারের জন্য পয়সা দেবে।
যা নিয়ে প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে গুগল কানাডার সরকারের সাথে একটা চুক্তি করেছে, যাতে দেশটির গণমাধ্যমগুলোকে বছরে এক শ’ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার দেবে এই টেক জায়ান্ট।
তবে আইনটি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে কানাডার ব্যবহারকারীদের জন্য ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে সংবাদ ব্লক করে রেখেছে মেটা। দুই পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে এখনো আলোচনা চলমান।
এর আগে অস্ট্রেলিয়ায় ২০২১ সালে একই রকম আইন পাশ হয়। সেখানে মেটা শুরুতে সংবাদ ব্লক করে রাখলেও পরে দাবি মেনে নেয় ও সেখানে বিভিন্ন অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে তারা।
অন্যান্য দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও এরকম আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে। নতুন বছরে তাই ভালোই চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে সামাজিক মাধ্যমগুলোর জন্য।
ওজন কমানোর দৌড়
ফার্মাসিউটিক্যালস দুনিয়ায় একটা ওষুধ এত বেশি বিক্রি হচ্ছে যে, এর উৎপাদনকারীরা চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে।
ওজন কমানোর ওষুধ সেমাগ্লুটাইড, বাজারে যেটি উইগোভি ব্র্যান্ডে পরিচিত। এটি দারুণ সাফল্য পেয়েছে। চাহিদা মেটাতে ড্যানিশ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এটির উৎপাদন বাড়াতে এখন আরো বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করছে।
এই মুহূর্তে ইউগোভি একটা ইঞ্জেনকশন আকারে আছে যা প্রতি সপ্তাহে নিতে হয়। কিন্তু এটির ট্যাবলেটও তৈরি হওয়ার পথে। নভো নরডিস্ক অবশ্য এখনো মুখ খোলেনি যে ঠিক কখন থেকে এটি বাজারে পাওয়া যাবে।
এলি লিলির ওষুধ মোনজারো সম্প্রতি ওজন কমানোর চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অনুমতি পেয়েছে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেরও অনুমতি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া ফাইজারও তাদের ওজন কমানোর ওষুধের অনুমতির অপেক্ষায় আছে।
সূত্র : বিবিসি