মো. মাসুম বিল্লাহ
বর্তমানে পুরো জগৎ আবদ্ধ সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক সময় সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়ার সংস্কৃতি ছিল। এখন এই সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। খবরের কাগজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। যেখানে বিশ্বে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় মুহূর্তের মধ্যে। তবে বেশিরভাগ মানুষ কোথায় কী হচ্ছে, কে কী পোস্ট করছে তা নিয়ে সবসময়ই কৌতূহল থাকে। মোবাইল ফোনের নটিফিকেশনে বুঁদ হয়ে থাকে নেটিজেনরা। এতে ড্রাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর আসক্তিতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও দিনের অধিকাংশ সময় বুঁদ হয়ে থাকে স্যোশাল মিডিয়ায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য, দেখা দিচ্ছে ডিপ্রেশন, ঘুমের ব্যাঘাত, এমনকি হতাশাগ্রস্তও। একটা সময় মানুষ প্রত্যক্ষভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করত। এরপর সময়ের বিবর্তনে সোশ্যাল মিডিয়ার আগমন। সময় বাঁচল, ব্যয় কমল, যোগাযোগের পরিবর্তনে এলো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম।
জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তির ফলে মস্তিষ্কে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়। যা ডোপামিন নামে পরিচিত। এতে ফলোয়ার আর লাইক বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় আরও বেশি বেশি আকর্ষণীয় কন্টেন্ট শেয়ার করছে অনেকেই। যত বেশি লাইক-কমেন্ট-শেয়ার হচ্ছে তত বেশি খুশি হচ্ছে তারা। আর তখনই খুশিতে তাদের ডোপামিন লেভেল বেড়ে যায়। এভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি বাড়তে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি এসেছে মানুষের সহায়তা করার জন্য কিন্তু সেই প্রযুক্তিই জীবনের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে। এদের অনেকেই রাত জেগে ফোন ব্যবহার করে থাকে। পর দিন বেলা ১১-১২টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। অথচ সকালে স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি কিংবা কাজে যাওয়ার কথা। কিন্তু অধিক রাত জাগার কারণে দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ পড়ে যায়। যার কারণে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।
আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ মেডিসিনের দেয়া এক তথ্যে জানা যায়, দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি যারা স্যোশাল মিডিয়ায় সময় ব্যয় করেন তাদের ২.৮ শতাংশ বেশি ব্যবহারকারী মানসিক অবসাদে ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রামের বেশি ব্যবহার একাকিত্বের অনুভূতি হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি প্রাধান্য দিলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মতো ব্যাধি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার বুলিং হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব প্ল্যাটফর্মগুলোকে ঘিরে মিথ্যা গুজব ও প্রতারণার শিকার হওয়ার নানান ফাঁদ রয়েছে। এতে ভুক্তভোগী দীর্ঘস্থায়ী মানসিকভাবে অসুস্থতা হয়ে যেতে পারেন। গবেষণা বলছে, ঋবধৎ ড়ভ সরংংরহম ড়ঁঃ (ঋঙগঙ) কোনো ব্যক্তিকে প্রতি কয়েক মিনিট অন্তর তার ফোন তুলতে বাধ্য করতে পারে, আপডেটের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া চেক করতে, অথবা ফোনের প্রতিটি ম্যাসেজ এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ার আপডেট চেক করতে গাড়ি চালানোর সময় ঝুঁকি নেয়া এবং রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়া ইন্টারঅ্যাকশনকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। গবেষণা আরও বলছে, অন্তহীন সেলফি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তির সমস্ত অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা শেয়ার করা একটি অস্বাস্থ্যকর আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি করতে পারে এবং তাকে বাস্তব জীবনের সংযোগ থেকে দূরে রাখতে পারে। সে পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দ্বারা চালিত হতে পারে এবং তার অহংবোধ বাড়িয়ে দিতে পারে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা সমাধান নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়ে সবার যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণের আগেই সব কিছু হাতের মুঠোয় চলে আসছে। এটির দায়িত্বশীল ব্যবহার করতে পারছে না অনেকেই। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়ে সবার যথেষ্ট শিক্ষা গ্রহণ ও এটির দায়িত্বশীল ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হরেক রকম মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়ে থাকে। যে কারণে স্ক্রিন স্ক্রল করার ক্ষেত্রে মন ও মস্তিষ্ক কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারে না বরং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যাটাসের বিষয়বস্তুর ওপর ভিন্ন ভিন্ন আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া, যেমন ভালো লাগা, খারাপ লাগা, বিরক্তিবোধ, রাগ ইত্যাদি অনুভূতি তৈরি করে। এতে মন ও মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ স্থিরতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রত্যেকটি মানুষ চিন্তা, চেতনায়, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্বে আলাদা। এখানে একের সঙ্গে অন্যের তুলনা করার সুযোগ নেই। যারা নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজস্ব ভাবমূর্তি অথবা আইডেনটিটি নির্মাণ করতে চায় তাদের মনের সুখ-দুঃখ মূলত নির্ভর করে অন্যের হাতে। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার অন্য মাধ্যমগুলো খুব সুনিপুণভাবে ব্যবহারকারীর ভেতর নিজেদের সব সময় অন্যের সঙ্গে তুলনা করার মানসিক প্রবণতাকে উসকে দেয়।
গবেষকরা বলছেন, যেহেতু এটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি, তাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি, ভালো বা খারাপ সম্পর্কিত গবেষণা খুব কমই হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে যেসব গবেষণা হয়েছে সেসবে উল্লেখ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ব্যক্তি জীবনে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, একাকীত্ব, আত্ম-ক্ষতি এবং এমনকি আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চিন্তা এমন কিছুর মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র পাওয়া গেছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বৈষম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়া ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিভক্তি বাড়িয়ে দিয়ে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে অহমিকাবোধ তৈরি হচ্ছে। আমিই সেরা, আমিই উত্তম এমন মনোভাব সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। সমাজে যারা ধনবান সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের জীবনযাত্রার ধরন যেমন বিদেশ ভ্রমণ, ভালো খাবার, ভালো বাড়ি, দামি গাড়ি, সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ালেখা, অবসর বা বিনোদন যাপনের আড়ম্বরপূর্ণতা, ইত্যাদির প্রদর্শনী সমাজে যারা পিছিয়ে রয়েছে তাদের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে। তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাবোধ তৈরি করছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নির্ভরতাই আসক্তি। এই নির্ভরতা ব্যক্তি, বস্তু বা কোনো কাজের প্রতিও হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়াও এমন এক ধরনের কাজ যার মধ্যে আসক্তির উপাদান খুবই তীব্র। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি ইন্টারনেটভিত্তিক আসক্তির একটা রূপ। কিশোর বয়সে ব্যক্তি তার আত্মপরিচয় খোঁজে, নিজেকে আবিষ্কার করতে চায়। সেখানে রাতের পর রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে, পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্পর্কগুলো দ্রুত হচ্ছে। সহজেই একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ হয়। এ কারণে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, একাধিক সম্পর্ক- এসবও বেড়ে যাচ্ছে অনেক। অনেক সময় ফেসবুকে এমন কিছু দেখছে যা তাদের ওপর প্রভাব ফেলছে। একপর্যায়ে বিষণ্নতা এমনকি নিজেকে শেষ করে দেয়ার মতো মারাত্মক এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকেও যেতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রিস্টার্ট মেন্টাল হেল্থ সার্ভিসের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর সিইও মো. ওয়াহিদ আনোয়ার রনো বলেন, মাদক যেমন আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন হরমোন ক্ষরণ ও নিউরো ট্রান্সমিটারের কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব রাখে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি আমাদের মস্তিষ্কের হরমোন ক্ষরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কিংবা শপিংয়ে আসক্তির মতো নন সাবস্টেন্স অ্যাডিকশনগুলোকে আমরা বিহেভিয়ারাল অ্যাডিকশন হিসেবে চিহ্নিত করি। তিনি আরও জানান, এগুলো একজন মানুষের প্রচুর সময় নষ্ট করে, আবেগীয় প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য নষ্ট করে, মুডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে, চিন্তা ও মনোযোগের ক্ষমতা হ্রাস করে। সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে মানুষ অনেক বেশি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, অহেতুক অর্থ খরচ করে। ফলে দেরি না করে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি থেকে বের হতে সাইকোথেরাপি নেয়া শুরু করতে হবে দ্রুততম সময়ে। তার মতে, ড্রাগের আসক্তির চেয়েও সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি।