অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল। বিরোধী জোট তো নয়ই; স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের (এমপি) আলাদা সংসদীয় জোটও হচ্ছে না। এমনকি সংসদ কক্ষে আওয়ামী লীগের হুইপিংয়ের অধীনেই থাকবেন তারা। সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য স্বতন্ত্র এমপিদের কোটার মনোনয়নও দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন একাধিক স্বতন্ত্র এমপি। বৈঠকে স্বতন্ত্র এমপিদের আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডান হাত ও বাঁ হাত দুটোই আমার। স্বতন্ত্ররা আমার দলেরই। আপনারা আমার; আপনারা দলেই আছেন। ’
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ৬২ স্বতন্ত্র এমপি সবাই উপস্থিত ছিলেন। ৫ থেকে ৭ জন ছাড়া প্রায় সবাই বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ সময় সব এমপি একযোগে তাদের আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানান।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দলেই আছেন। আপনারা তো আমারই।’ এ সময় স্বতন্ত্র এমপিদের পক্ষ থেকে নারী আসনের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যদের আনুপাতিক হিসাবে দ্বাদশ সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে স্বতন্ত্রদের ১০ জনকে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত চলে এ বৈঠক। সঞ্চালনা করেন একাদশ সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে একাধিক স্বতন্ত্র এমপি সংসদ কক্ষের কার্যক্রমে তাদের হুইপিং কীভাবে হবে– সে প্রশ্ন তুললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় হুইপিংয়ের অধীনে স্বতন্ত্র এমপিরা থাকবেন। চিফ হুইপ আছেন, আরও আটজন হুইপ আছেন। যাঁর বিভাগের যে হুইপ থাকবেন, তাঁর হুইপিংয়ে ওই এমপি কাজ করবেন।
ওবায়দুল কাদেরের ব্রিফিং
বৈঠক শেষে গণভবনের প্রধান ফটকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বতন্ত্ররা স্বতন্ত্রই থাকবেন। তবে তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন– এই একটা বিষয় সংসদ নেতা, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কারভাবে বলেছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নেতাকর্মীর মধ্যে কিছু সংঘাত, অন্তর্কলহ হয়েছে। এখনও বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী এগুলো মেটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, স্বতন্ত্র এমপিরা জানিয়েছেন– নিজেদের আওয়ামী লীগের বাইরে ভিন্ন পরিচয় দিতে তাদের আবেগ এবং বিবেক আহত হয়। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে বিবাদ ও অন্তর্কলহ মেটাতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংসদ নেতা শেখ হাসিনা যাদের মনোনীত করবেন, তাদের প্রতি সমর্থন থাকবে স্বতন্ত্র এমপিদের।
দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
বৈঠকের শুরুতে স্বতন্ত্র এমপিদের উদ্দেশে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, দেশবাসীর জন্য যেসব প্রকল্প অর্থবহ হয়, সেগুলোই সরকার গ্রহণ করে থাকে। স্বতন্ত্র এমপিদের নির্বাচনী এলাকায় কেউ ভূমিহীন-গৃহহীন থাকলে তাদেরও ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে।
উপস্থিত এমপিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হবে। সংবিধান আত্মস্থ করতে হবে। সংসদ কার্যপ্রণালি বিধি পড়তে হবে। আমাদের সংসদ ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের। কাজেই সংসদীয় চর্চা ভালো করে জানতে হবে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ২২৩ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পদধারী ৫৭ জন। বাকি পাঁচজনও কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী পরিবারের সদস্য কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত। তাই সংসদে তারা আওয়ামী লীগের হয়েই প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছিলেন।
এ পরিস্থিতিতে নতুন সংসদে স্বতন্ত্র সদস্যদের ভূমিকা কী হবে– তা নিয়ে তাদের দিকনির্দেশনা দিতেই বৈঠকে ডাকেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
এত দিন সংসদে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে কিংবা স্বতন্ত্র এমপিরা বিরোধী দলের আসনে বসবেন কিনা– এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চললেও গতকাল তার অবসান ঘটে। নির্বাচনে ১১ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টিকেই (জাপা) বিরোধী দলের স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে আরও জানানো হয়েছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার। ফলে জাপার চেয়ে সাড়ে পাঁচ গুণ আসনে জেতা স্বতন্ত্র এমপিরা আলাদা জোট করে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকছেন না– সেটাও নিশ্চিত হয়ে গেছে।
যা বললেন স্বতন্ত্র এমপিরা
বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এ. কে. আজাদ বলেন, আমরা নৌকা পাইনি, কিন্তু দলের বিভিন্ন পদে ও দায়িত্বে আছি। আবার আমরা স্বতন্ত্র এমপিও। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, এলাকায় কাজ করতে নানা অসুবিধা হচ্ছে। সুতরাং দলের মধ্যে যেহেতু আছি, সেহেতু আমাদের একত্রিত করা হোক।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, স্বতন্ত্র হিসেবেই তোমরা কাজ করো। এখানে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ এটা আমার ডান হাত, ওটা আমার বাঁ হাত। যারা দলীয় মনোনয়ন পায়নি, তারা সংসদে বেশি আলোচনা ও সমালোচনার সুযোগ পাবে। বিভিন্ন বিলের ওপরে নৌকা প্রতীকের এমপিদের কথা বলার সুযোগ কম থাকে, কিন্তু স্বতন্ত্রদের বেশি সুযোগ রয়েছে।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি নির্বাচন নিয়ে স্বতন্ত্রদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে এ. কে. আজাদ বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলে এসেছি, যারা দীর্ঘদিন দলের জন্য কাজ করেছেন এবং যারা সংসদে জনগণের জন্য ভূমিকা রাখতে পারবেন– এমন নারীদের মনোনয়ন দিন। এটা আমরা নিজে থেকেই বলে এসেছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আওয়ামী লীগ এখানে এসেছে, সেসব পরিবারকে স্বীকৃতিস্বরূপ সংরক্ষিত মহিলা আসন দিতে আমরা অনুরোধ করেছি।
স্বতন্ত্র এমপিরা দলের সাংগঠনিক কাজে জড়িত থাকতে পারবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই তারা জড়িত থাকতে পারবেন। কারণ তারা সংগঠনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং এটাতে কোনো বাধা নেই।
ফরিদপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, এলাকায় স্বতন্ত্রদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তিনি দেখতে চান না। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। এ ছাড়া যারা নতুন সংসদ সদস্য হয়েছে, তাদের নিজেদের কাজ সম্পর্কে জানতে হবে, পড়তে হবে।’
হবিগঞ্জ-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, আজকে আমার জন্য অত্যন্ত একটি ভালো দিন যে, প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আমি তাঁকে বলেছি, ‘নেত্রী, যারা নৌকা নিয়ে পাস করে এসেছেন, তারা হচ্ছেন আপনার রেগুলার ফোর্স। আর আমরা যারা স্বতন্ত্র হিসেবে পাস করে আসছি, আমরা হচ্ছি রিজার্ভ ফোর্স। এই দুই ফোর্সই কাজ করবে দেশের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবই তো আমার।’
পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র এমপি সবার পরিচয় নিয়েছেন, সবার কথা শুনেছেন। ৬২ জন স্বতন্ত্র এমপি সবাই মিলে আমরা দাবি করেছি– আমরা আওয়ামী লীগের লোক, আওয়ামী লীগেই থাকতে চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে চলতে চাই।