অন্যরকম এক সংসদের যাত্রা শুরু আজ অধিবেশন বসবে বেলা ৩টায়, ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি  ৪৪ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে পাঁচটির ২৯৯ এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা ২৮০ জন, দলটির জোট-মিত্রের বাইরে মাত্র পাঁচ জন

অন্যরকম এক সংসদের যাত্রা শুরু আজ অধিবেশন বসবে বেলা ৩টায়, ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি ৪৪ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে পাঁচটির ২৯৯ এমপির মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা ২৮০ জন, দলটির জোট-মিত্রের বাইরে মাত্র পাঁচ জন

মেয়াদ শেষ হলো নানা ঘটনায় আলোচিত একাদশ জাতীয় সংসদের। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি শুরু হওয়া একাদশ সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার। আজ মঙ্গলবার যাত্রা শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের। ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এই সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ বিকাল ৩টায়। সংবিধান অনুযায়ী, সরকার ও সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ গণনা শুরু হয় সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে।

দ্বাদশ সংসদ প্রায় সব ধরনের হিসাব-নিকাশ, বিশ্লেষণ ও সমীকরণেই ‘অন্যরকম’। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে নতুন এই সংসদে। আবার, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চার বারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগেরই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজনৈতিক মিত্র সংসদে প্রতিনিধি থাকা অবশিষ্ট চারটি দল।

নওগাঁ-২ আসন ছাড়া ২৯৯টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই পেয়েছে ২২৩টি। আর বিজয়ী স্বতন্ত্র ৬২ জনের মধ্যেও ৫৭ জনই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। সেই হিসাবে, ২৯৯ জনের মধ্যে ২৮০ জনই মূলত ‘আওয়ামী লীগ দলীয়’ সংসদ সদস্য। দল, দলীয়-স্বতন্ত্র ও জোট মিলিয়ে দ্বাদশ সংসদে কার্যত আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য ৯৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একপক্ষীয়। গত ১৭ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বলেছে, ‘‘এবারের নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এ নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক অবনমনের অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনি কৌশল ও অভিনবত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হবে।”

আজ স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি

নিয়ম অনুযায়ী আজ বিকাল ৩টায় অধিবেশন শুরু হবে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে। এরপর পর্যায়ক্রমে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হবে। গত ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সরকারি দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় টানা চার বারের মতো স্পিকার হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। আর ডেপুটি স্পিকার হিসেবে শামসুল হক টুকুকে মনোনীত করা হয়। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিন ও ডেপুটি স্পিকার হিসেবে টুকু আবারও নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর অধিবেশন কিছু সময়ের জন্য মুলতুবি করা হবে। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নেবেন নবনির্বাচিত স্পিকার। ডেপুটি স্পিকারও শপথ নেবেন। শপথের পর স্পিকারের সভাপতিত্বে পুনরায় অধিবেশন শুরু হবে। এরপর ইংরেজি নতুন বছর ২০২৪ সালের প্রথম অধিবেশন হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী অধিবেশনের আজ প্রথমদিনে বিকাল সাড়ে চারটায় ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি। পরে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেবেন সংসদ সদস্যরা। সাধারণত বছরের প্রথম অধিবেশনটি দীর্ঘ হয়। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনটি চলতে পারে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে।

প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন ছাড়াও অধিবেশনের জন্য সভাপতিমণ্ডলী মনোনয়ন এবং শোক প্রস্তাব ও অধ্যাদেশ উত্থাপন (যদি থাকে) হবে। তবে, রেওয়াজ অনুযায়ী আজ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের উত্তরের জন্য কোনো প্রশ্নকাল থাকছে না। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর অধিবেশন মুলতুবি করা হবে। নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু উপলক্ষে সংসদ ভবন এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ফুলের টব দিয়ে সাজানো হয়েছে। নবগঠিত সংসদের প্রথম বৈঠক প্রত্যক্ষ করার জন্য স্পিকার দেশের বিশিষ্টজনদের ছাড়াও কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

প্রতিনিধিত্ব রয়েছে মাত্র পাঁচটি দলের

এবারের নির্বাচনে ২৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে আওয়ামী লীগসহ মাত্র পাঁচটি দল। ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ২২৩টিতে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৬২টি আসনে। ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে জাতীয় পার্টি (জাপা) পেয়েছে ১১টি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) রেজাউল করিম তানসেন এবারও এমপি হয়েছেন। এর বাইরে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রথম বারের মতো এমপি হয়েছেন নিজ দলীয় প্রতীক ‘হাতঘড়ি’ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

২৮০ জনই আওয়ামী লীগের যেভাবে

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২২৩টি আসন প্রাপ্তির পাশাপাশি অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ৬২টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাদের মধ্যে ৫৯ জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ৫৯ জনের মধ্যে ৫৭ জনেরই আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো স্তরের দলীয় পদ রয়েছে। ২২৩ আর ৫৭ মিলে ২৮০ জনই সরাসরি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা।

জোট-মিত্রের হিসাব

আওয়ামী লীগের নেতাদের বাইরে বিজয়ী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের রেজাউল করিম তানসেন ১৪ দলের শরিক। তারা দুই জনই ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। এবার জাপাকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে জাপা ১১টি আসনে জয়ী হয়েছে। তবে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে (গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর) জাপার জন্য ২৫টি আসনে ছাড় দেওয়ার বিষয় অবহিত করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) যে চিঠি দিয়েছিল, সেটিতে ‘জোট’ কথাটি উল্লেখ ছিল। উল্লেখ্য, ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে জাপা। সবমিলিয়ে বলা যায়, দ্বাদশ সংসদের ২৯৪ জন সদস্যই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অংশীদার বা রাজনৈতিক মিত্র। একাদশের মতো দ্বাদশ সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকছে জাপা।

কিছুটা ব্যতিক্রম পাঁচ জন

মাত্র পাঁচ জন এবার সংসদে এসেছেন ভিন্ন দল বা মতের। তাদের মধ্যে তিন জনকে জেতার আশ্বাস দিয়ে ভোটে আনা হয়েছে। এর মধ্যে নীলফামারী-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন জেলা জাপার সহ-সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার হওয়া সিদ্দিকুল আলম। রয়েছেন সিলেট-৫ আসনের মোহাম্মদ হুছামউদ্দিন চৌধুরী, যিনি ফুলতলীর হুজুরের ছেলে ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আঞ্জুমানে আল ইসলাম সভাপতি। হুছামউদ্দিনও অবশ্য আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবেই পরিচিত। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গত ৬ ডিসেম্বর হুছামউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, নৌকার প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও হুছামউদ্দিনকে জিতিয়ে আনতে সরকারের বিভিন্ন মহলের তৎপরতা ছিল। এমনকি তার পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদেরও নামানো হয়।

কক্সবাজার-১ আসন থেকে জয়ী হন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ২০০৭ সালে ইবরাহিমের নেতৃত্বে কল্যাণ পার্টির জন্ম হয়। গত নভেম্বরের শেষদিকে বিএনপির মিত্রজোট থেকে বেরিয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন ইবরাহিম। আলোচনা আছে, তাকে জেতানোর আশ্বাস দিয়েই ভোটে আনা হয়। প্রচার থেকে শুরু করে ভোট পর্যন্ত তাকে জেতাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয় বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে জয়ী হয়েছেন সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ার পর বিএনপি তাকে বহিষ্কার করে। স্বতন্ত্র ভোট করলেও তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় অংশকেই পাশে পেয়েছেন। কিছুটা ব্যতিক্রমী পাঁচ জনের অবশিষ্টজন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি হয়েছেন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ