নিজস্ব প্রতিবেদক
বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর খতনা করাতে ছেলে আয়ান আহমেদকে (৫) নিয়ে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন বাবা-মা। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি আয়ানের। সাত দিন পর ছেলের লাশ নিয়ে ফিরতে হয় বাড়ি। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যেই মঙ্গলবার জে এস মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আহনাফ তাহমিদ মারা গেছে। অভিযোগ সেই একই অ্যানেসথেসিয়ায় অবহেলা।
গত সোমবার ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করতে গিয়ে ৩২ বছরের যুবকের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় রিপোর্ট না দেখে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার অভিযোগ করে পরিবার। ইবনে সিনা হাসপাতালে ওয়ার্ডবয়ের বিরুদ্ধে রুশ কিশোরীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। ধারাবাহিক এসব ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি। দেশের পাঁচ তারকা হাসপাতাল, সাধারণ ক্লিনিক কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না অভিযোগের তালিকা থেকে। এটা কি অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা নাকি অবহেলা তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। চিকিৎসায় অবহেলাজনিত বিষয়ে অভিযোগ করার একমাত্র সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসার অবহেলায় ২৮০টির মতো অভিযোগ জমা পড়েছে এখানে। এর মধ্যে মাত্র ৪০টির মতো নিষ্পত্তি করতে পেরেছে তারা। চিকিৎসায় ভুল ও অবহেলা সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে এভাবে রোগী মৃত্যুর বড় কারণ অদক্ষতা এবং জবাবদিহিতার অভাব। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারে যতটা স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ প্রয়োজন তা নেই। নইলে এভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক গড়ে ওঠে কীভাবে। অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেই শুনি সে ক্লিনিকের লাইসেন্স নেই। তাহলে এতদিন প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছিল কীভাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে স্বাস্থ্য শিক্ষার মানও নিম্নগামী। এসব শিক্ষার্থী উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই চিকিৎসক হচ্ছে। টাকা খরচ করলেও মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। নইলে ইউনাইটেড, ল্যাবএইডের মতো করপোরেট হাসপাতালে কীভাবে এসব ঘটনা ঘটে। শুধু স্বাস্থ্য নয়, দেশের সব খাতেই বিশৃঙ্খলা, দায়সারা আচরণ চলছে।’ রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে শিশু আহনাফ তাহমিদের মৃত্যুর ঘটনায় ওই হাসপাতাল সিলগালা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ প্রতিষ্ঠানের শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন ছিল। হাসপাতালের অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ঘটনায় যতটুকু জেনেছি তা নিয়ে আমার মন্তব্য হচ্ছে রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পূর্ববর্তী সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। অবহেলায় এরকম গুরুত্বপূর্ণ সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে।’ পাঁচ বছর বয়সী আয়ানকে খতনা করানোর জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাঁতারকুল এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল তার পরিবার। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। গত ৭ জানুয়ারি সেখানেই মৃত্যু হয় শিশুটির। শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার ফের তদন্তের নির্দেশ দিয়ে নতুন কমিটি করে দিয়েছেন হাই কোর্ট। কমিটিকে বিষয়টি অনুসন্ধান করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে রিট আবেদনকারী আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জানান। এর আগে ২৯ জানুয়ারি এ মামলার শুনানিকালে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে ‘আইওয়াশ‘ও ‘হাস্যকর‘ বলেছিলেন বিচারক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত এক রুশ নারী তার মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে এলে কল্যাণপুর ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েটি শ্লীলতাহানির শিকার হন। আবুল কাশেম নামে ইবনে সিনার এক ওয়ার্ডবয় ওই রুশ মেয়েকে চিকিৎসার নামে নানাভাবে শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই নারী ওয়ার্ডবয় কাশেমকে আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। কাশেমকে ওই দিনই গ্রেফতার করে পুলিশ। কাশেম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর হাসপাতালের লাইসেন্স ছিল না বলা দায়সারা আচরণ। স্বাস্থ্যসেবা দিতে গেলে হাসপাতাল, ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ ধরনের ঘটনায় কাউকে দায়ী করার আগে দেখতে হবে যিনি সেবা দিয়েছেন তিনি এ কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি কি না, তার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছিল কি না। কাউকে দায়ী করার আগে এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। এ ধরনের ঘটনা দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে।’ রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও এমন একটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। সে ঘটনায় আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছি।
তবে সেই ঘটনার পরও যারা সতর্ক হতে পারেনি, এরকম আর কারও কোনোরকম দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে শুধু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াই হবে না, ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলাকারী দোষীদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এরকম গুরুদায়িত্বে অবহেলা করতে সাহস না পায়। চিকিৎসায় অবহেলা পাওয়া গেলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’